মুক্তবাজার অর্থনীতি। যেখানে কারও হস্তক্ষেপ ছাড়াই নিশ্চিত হয় সবার অংশগ্রহণ। অর্থনীতির মুক্তবাজার নীতি অনুসরণ করা বাংলাদেশে গেল ১৫ বছরে আর্থিক ও বাণিজ্য খাতে কি সেই নীতির প্রতিফলন ছিল?
কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী শাসনামলের অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতায় সে প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট। মুক্তবাজার থেকে সরে এসে গোষ্ঠীতান্ত্রিক বাণিজ্যনীতিতে পরিণত হয় পুরো খাত। যার একচেটিয়া সুবিধা পেয়েছে বেক্সিমকো, এস আলমসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠানসহ আওয়ামী লীগের আত্মীয়স্বজন।
২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ২৪টি বড় অনিয়মে শুধু ব্যাংক থেকে লুট হয়েছে ৯২ হাজার কোটি টাকার বেশি, আর এডিপি'র ৪০ শতাংশ অর্থ লুটপাট করেছে আমলারা। এই সময়ে খেলাপি ঋণ প্রায় সাত লাখ কোটি টাকা। এছাড়াও দুই লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকার ঋণকে ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকায় পরিণত করে, দেশ ছেড়ে পালিয়েছে শেখ হাসিনা।
আর গেল ১৫ বছরে শুধু পাচার হয়েছে ২৮ লাখ কোটি টাকা। যা গেল পাঁচটি জাতীয় বাজেটের চেয়ে বেশি। শুধু কি পাচার? আওয়ামী দুঃশাসনের সময় পুরো বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে নেয় দেশের কালো অধ্যায়ের এই কারিগররা। চাল, ডাল, তেল থেকে নুন, সবই ছিল তাদের কব্জায়।
এছাড়া ব্যাংক খাতে ব্যাপক জালিয়াতি, রিজার্ভ চুরি কিংবা শেয়ারবাজার লুটের মাঝেই চলতে থাকে রপ্তানি হিসাবে গড়মিলের মতো জাতীয় কেলেঙ্কারি। গেল ১০ বছরে এনবিআরের চেয়ে রপ্তানির হিসাব বেশি দেখিয়েছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো।
এ অবস্থায় সিপিডি বলছে, দেশের প্রায় ১৭ শতাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রধান বাধা দুর্নীতি। শেখ হাসিনার আমলে করা এই জরিপে ডলারের অস্থিরতাসহ সাতটি খাতের দুরবস্থা উঠে আসে। এর জন্য ব্যবসায়ীদের রাজনীতিকরণ আর রাজনৈতিক বলয়ে থাকা বাণিজ্যিক সংগঠনগুলোর মুখে কুলুপ দেয়াকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক প্রেসিডেন্ট আবুল কাসেম খান বলেন, 'সংস্থাগুলো একেবারে স্বাধীন হওয়া উচিত। এবং যারা সভাপতি, সহ-সভাপতি হবেন তারা কোনো পলিটিক্যাল পার্টির মেম্বার হওয়া উচিত না। দলীয়করণের উদ্দেশ্যটা কী ছিল? পলিটিক্যাল সাইড থেকে ছিল যে কোনো বিরোধিতা হবে না। এদিকে ব্যবসায়ীরা কী চিন্তা করছে? আমি সরকারের ট্রাস্টেড লোক, তাহলে আমিও কিছু আদায় করে নিতে পারি এই সুযোগে।'
রাইজিং গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, 'গোষ্ঠীতান্ত্রিকতা ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প উন্নয়নয়, দেশের অর্থনীতি এমনকি রাজনীতি কোনো অবস্থাতেই ভালো না। নীতি ঠিক করে দিতে হবে, সেই নীতি অনুযায়ী সবাই যে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারেন। তাহলেই দেশের অর্থনীতি উপকৃত হবে।'
লুট হওয়া অর্থ দেশের জিডিপির প্রায় দুই শতাংশ। এ অবস্থায় কমবে জিডিপি, মাথাপিছু আয়, অর্থনীতির নানা সূচক। এসব অনিয়ম বন্ধ করা না গেলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ঠিক হবে না বলে সতর্ক করছেন অর্থনীতিবিদরা।
অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, 'আমাদের যে সংস্কার উদ্যোগগুলো, সেগুলো যেন একেবারে রাজনৈতিকভাবে সমাধানযোগ্য প্রস্তাব যেন নিয়ে আসে, যেন নতুন যে সরকারই আসুক তারা যেন এই ধরনের সমাধানগুলো করার ক্ষেত্রে তারা যেন অস্বস্তিবোধ না করে।'
অর্থনীতিবিদ ড. মিজানুর রহমান বলেন, 'যেভাবে আছে এভাবে থেকে যদি নতুন আরেকটা সরকার আসে, তাহলে এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। যেকোনো সরকার ক্ষমতায় আসলে যারা বিরোধী দলে থাকে তখন এই কালো আইনগুলোর বিরোধিতা করে তারা। আবার তারা যখন ক্ষমতায় আসে ওই আইনগুলোই তাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে যায়, এটাকে তারা ব্যবহার করে।'
সম্প্রতি জাতীয় খানা জরিপে দেখা গেছে দেশের শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান পাসপোর্ট বিভাগ, বিআরটিএ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। এগুলো তো আছেই। তবে গেল ১৫ বছরে ব্যাংক, জ্বালানি, ভৌত অবকাঠামো এবং আইসিটি খাত- এই শীর্ষ চার খাতে সবচেয়ে বড় দুর্নীতি হয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
তাই আমদানি-রপ্তানি, বাণিজ্যসহ দেশের আর্থিক খাতের প্রবৃদ্ধি রক্ষায় মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারা বজায় রাখার পাশাপাশি বাণিজ্যিক কাঠামো যাতে ক্ষমতার বলয়ে গোষ্ঠীতান্ত্রিকতার কবলে আর না পড়ে সে বিষয়ে স্থায়ী সমাধানের বিষয়ে জোর দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।