দুই সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহে পাঁচ দশকের স্বৈরশাসকের আকস্মিক যে পতন দেখলো সিরিয়া, পশ্চিমা কোনো গোয়েন্দা সংস্থা তা আগে থেকে আঁচ করতে পারেনি। অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে আসাদ বাহিনীর দুর্বলতম অবস্থানের কথাও ছিল অজানা।
উত্তর-পশ্চিম উপকূলে আধিপত্য ও প্রভাব এখনও ধরে রেখেছে দেশের সবচেয়ে বড় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী আলাউইত শিয়ারা। কিন্তু রাজধানী দামেস্কে তাদেরই প্রতিনিধি, ১৯৭১ সাল থেকে দেশটির ক্ষমতায় থাকা আসাদ পরিবারের পতন ঘটেছে আক্ষরিক অর্থে- এক রাতেই।
সিরিয়ান নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইটসের তথ্য, ২০১১ সাল থেকে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে প্রাণ গেছে প্রায় ছয় লাখ মানুষের, যাদের মধ্যে তিন লাখের বেশি ছিলেন বেসামরিক। ৯০ শতাংশের বেশি বেসামরিক প্রাণহানির নেপথ্যেও আসাদপন্থিরা। এ হিসেবে একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম বড় গণহত্যাকারী হিসেবে বিবেচিত সিরিয়ার ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ।
গেলো দেড় দশকই প্রমাণ করে আড়াই দশক ধরে ৫৯ বছর বয়সী এ নেতা আর তার আগে তিন দশক তার বাবা হাফিজ আল-আসাদের সুদীর্ঘ শাসনামল ও ক্ষমতায় টিকে থাকতে একের পর এক নির্মমতার প্রতিক্রিয়ায় মূলত বিদ্রোহীদের এমন উত্থান।
গেলো এক দশকে মধ্যপ্রাচ্যে বহুমুখী সংঘাতের কেন্দ্র হয়ে ওঠা সিরিয়া আসাদের আকস্মিক পতনে মিত্রদের প্রভাবশূন্য হয়ে পড়ায় ঝুঁকি আর অনিশ্চয়তা বেড়েছে বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, ‘ভুললে চলবে না যে আসাদের পতন ঘটেছে যে বিদ্রোহীদের হাত ধরে, তাদের বিরুদ্ধেও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এসব বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নেতাদের সাম্প্রতিক কিছু বিবৃতি আমরা বিশ্লেষণ করে দেখেছি যে তারা এখন সঠিক পথেই আছে। কিন্তু বৃহত্তর দায়িত্ব ও স্বার্থে তাদের কথার সাথে কাজও পর্যবেক্ষণ করবো আমরা।’
গৃহযুদ্ধের প্রথমার্ধ বেশ বিপদসংকুল ছিল আসাদ সরকারের জন্য। বিশেষ করে ২০১৫ সালে দেশের তিন-চতুর্থাংশ অঞ্চল হাতছাড়া হয় দামেস্কের, যা নিয়ন্ত্রণে চলে যায় সশস্ত্র আসাদবিরোধীদের।
পরবর্তীতে রাশিয়া, ইরান আর ইরান সমর্থিত লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ একযোগে সিরিয়ায় সহিংস হস্তক্ষেপ করলে টিকে যায় আসাদ ও তার প্রশাসন। ২০১৮ সাল নাগাদ ইসরাইল সীমান্তবর্তী সিরীয় গোলান উপত্যকাসহ প্রধান সব অঞ্চলে বিদ্রোহীদের পতন ঘটলে স্থবির হয়ে যায় বিপ্লব। যদিও বাস্তবে স্বল্প পরিসরে হলেও যুদ্ধ অব্যাহত ছিল।
দু'সপ্তাহ আগে অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহৎ শহর আলেপ্পো পুনর্দখলের মাধ্যমে আসাদবিরোধীরা বুঝিয়ে দিয়েছিল, স্বৈরশাসকের পতন কেবল সময়ের ব্যাপার।
দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ আর স্বৈরশাসনে ক্লান্ত বিধ্বস্ত সাধারণ সিরীয়রাও খুশি সিরিয়ায় ক্ষমতার এমন আকস্মিক পটপরিবর্তনে। যা পাল্টে দিতে পারে পুরো মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক সমীকরণও। বিশ্লেষকরা বলছেন, ঐতিহাসিক এ পরিবর্তনে সুসময় যেমন ফিরতে পারে, তেমনি অনিশ্চয়তার দিকে চলে যেতে পারে পুরো অঞ্চল।
চ্যাথাম হাউজের ফেলো ডিআর হাইদ হাইদ বলেন, ‘প্রথমবার সিরিয়ার মানুষ কোনো সম্ভাবনা দেখছে যে সামনে হয়ত আজকের চেয়ে ভালো কিছু ঘটবে। নিশ্চিতভাবেই পরিস্থিতি আরও খারাপ দিকে যাওয়ার শঙ্কাও আছে। আসাদ ক্ষমতায় থাকলে কী ঘটবে তা নির্দিষ্ট ছিল। ১৩ বছরের গৃহযুদ্ধ আরও দীর্ঘ হওয়া, পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়া এবং আসাদের ছেলের হাতে ক্ষমতা যাওয়া। এখন এটি অন্তত হচ্ছে না।’
আসাদের পতন ইরানের আঞ্চলিক শক্তিতে এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় আঘাত। ক্ষতিগ্রস্ত যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা আধিপত্য বিরোধিতায় নেতৃত্ব দেয়া রাশিয়াও।
এতে প্রাথমিকভাবে লাভবান যুক্তরাষ্ট্র ও ঘনিষ্ঠতম মিত্র ইসরাইল। আসাদ ও মিত্র ইরান-রাশিয়ার বিরুদ্ধে জয়ের লক্ষ্যে গেলো কয়েক বছরে বিদ্রোহীরা পশ্চিমা বিরোধিতার সুর নমনীয় করেছে বলে মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতা আরও সুসংহত হলো ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের।
কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, মধ্যপ্রাচ্যের অন্য যেকোনো পরিবর্তনের মতোই সিরিয়ায় স্বৈরশাসনের পতনেও লাভের সঙ্গে রয়েছে অনেক জটিলতাও। আসাদকে হটানোয় নেতৃত্ব দেয়া হায়াত তাহরির আল-শাম, তথা এইচটিএস এককালে নিষিদ্ধঘোষিত আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে তাদের জয়ে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে উগ্রবাদ প্রতিষ্ঠা পেতে পারে বলে নতুন করে শঙ্কা দেখা দিয়েছে, যেমনটা ঘটিয়েছিল জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস।