কানাডা আর মেক্সিকোর ওপর শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত একদিন পেছালেও রেহাই পেলো না চীন। আমদানি পণ্যে ১০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হলো মঙ্গলবার থেকেই। প্রতিক্রিয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে মার্কিন কয়লা, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস, জ্বালানি তেলসহ নানা পণ্যে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পাল্টা শুল্কারোপের ঘোষণা দিয়েছে শি জিনপিং প্রশাসন। আর মধ্য দিয়ে আরও একবার বিশ্ব ফিরে গেলো ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে শীর্ষ দুই অর্থনীতির দেশের বাণিজ্য যুদ্ধে। ভিন্নতা এসেছে শুধু অর্থের অঙ্কে।
চীন গুগলের মতো মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সতর্কবার্তা দিয়ে রেখেছে, আসতে পারে সেগুলোর ওপরও নিষেধাজ্ঞা। ব্রিটিশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যাপিটাল ইকোনমিক্স বলছে, চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বার্ষিক আমদানির ২ হাজার কোটি ডলারের পণ্যে শুল্কারোপ করছে। অন্যদিকে, চীনের ৪৫ হাজার কোটি ডলারের পণ্যে শুল্কারোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। চীনের অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এরমধ্য দিয়ে ওয়াশিংটনকে বেইজিং একটা কঠোর বার্তা দিয়েছে। কারণ এই মুহূর্তে কোন বাণিজ্যযুদ্ধ চায় না বেইজিং।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ব্রহ্ম ছেল্লানি বলেন, 'চীন বুঝে শুনে ধীরগতিতে এগোচ্ছে। কোনো বাণিজ্যযুদ্ধে বেইজিং যেতে চায় না। কারণ, চীনের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আমদানির চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চারগুণ বেশি পণ্য রপ্তানি করে চীন। এককভাবে বেইজিংকে টার্গেট করেছেন ট্রাম্প। চীন পাল্টা পদক্ষেপ না নিলে শি জিনপিংকে দুর্বল মনে করতো ওয়াশিংটন। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধের অভিজ্ঞতা বেইজিংয়ের জন্য ভালো নয়।'
শি জিনপিং প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি খাতকে লক্ষ্য করে শুল্কারোপ করায় কমেছে যুক্তরাষ্ট্রের অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দর। শেয়ারবাজারেও বিভিন্ন সূচকের দরপতন হয়েছে। কমেছে ডলারের মূল্যমানও। এছাড়াও, চীন আরও শুল্কারোপ করেছে কয়েকটি ধাতু যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির ওপর। এরমধ্যে রয়েছে টাংস্টেন, যা ব্যবহৃত হয় বৈদ্যুতিক সামগ্রী, সমরাস্ত্র আর সোলার প্যানেল তৈরিতে। তবে চীনের এই শুল্ক ১০ ফেব্রুয়ারির আগে কার্যকর হবে না, কারণ বেইজিং চাইছে আলোচনার মধ্য দিয়ে সমস্যার সমাধান হোক।
চীনের স্থানীয় একজন বলেন, 'দিন দেশে দুই পক্ষের ভোগান্তি হবে। দুই পক্ষের উচিত, আলোচনায় বসে বাণিজ্য যুদ্ধের অবসান করা। কিন্তু সবকিছু নির্ভর করছে ট্রাম্পের ওপর।'
যদিও চীনের জন্য অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের ক্ষুদ্র উৎস যুক্তরাষ্ট্র। গেলো বছর ৬০০ কোটি ডলারের জ্বালানি ওয়াশিংটন থেকে আমদানি করেছে বেইজিং। চাহিদার ৫ শতাংশ এলএনজি আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, কোনোকিছুর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চীনের অর্থনীতি নির্ভরশীল না হলেও যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি কমলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আবার সেন্টার ফর স্ট্র্যটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ বলছে, চীনের টাংস্টেন, টেলুরিয়াম, মোলিবডেনাম আর রুথেনিয়ামের মতো ধাতুর ওপর যুক্তরাষ্ট্র নির্ভরশীল। এই ধাতুগুলো আধুনিক প্রযুক্তি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি আর জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে প্রস্তুত করা বিভিন্ন যন্ত্রে ব্যবহার করা হয়। অর্থনীতিবিদনরা বলছেন, এই নিষেধাজ্ঞায় চীনের চেয়ে বেশি ক্ষতি হবে যুক্তরাষ্ট্রেরই।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি তৈরির পাশাপাশি প্রযুক্তির উন্নয়নে কাজে লাগে, বিশ্বের দুর্লভ এমন খনিজগুলোর বেশিরভাগই চীনের দখলে। রপ্তানির ৮০ শতাংশ টাংগেস্টান আর বিসমাথের দখল রয়েছে বেইজিংয়ের। এই ধাতুগুলো ব্যবহৃত হয় সমরাস্ত্র তৈরিতে। ফলে, অস্ত্র তৈরি করতে গিয়েই বিপাকে পড়তে হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রকে। আর এটি হয়ে থাকলে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশটির সামরিক খাত।
বিশ্লেষকদের মতে, এই শুল্কযুদ্ধ পকেট কাটবে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের। বাড়বে স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, গেমিং পণ্য, খেলাধুলার সামগ্রী আর জুতার দাম। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অনেক ইস্যুতে দুই দেশের মতবিরোধ না থাকলেও শুল্ককে অস্ত্র হিসেবে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে ব্যবহার করবে দুই দেশই। যে কারণে চলতি বছর বিশ্ব অর্থনীতি আবারও হতে পারে টালমাটাল।