গাজা উপত্যকায় ৬ মাসের বেশি সময়ের যুদ্ধ নাটকীয় মোড় নিয়েছে শনিবার। মধ্যরাতে ইরানের চালানো ৩ শতাধিক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ঠেকাতে ব্যস্ত ছিলো ইসরাইল। যদিও ৯৯ শতাংশ হামলা ঠেকানোর দাবি দেশটির সেনাবাহিনী- আইডিএফ এর। প্রক্সি ছেড়ে ইরানের যুদ্ধের ময়দানে নামার ফলাফল ও ভবিষ্যত সম্ভাবনা ব্যাখ্যা করছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও বিশ্লেষক।
রাফায় অভিযান চালানোর বিষয়ে বারবার ইসরাইলকে বাঁধা দিচ্ছিলো যুক্তরাষ্ট্র। একসময় উপত্যকা থেকে অধিকাংশ সেনা প্রত্যাহার করে নেতানিয়াহু প্রশাসন। তবে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত না করতে পারলে সংকটে পরে যেতো ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার। দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন বলছে, মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে দিয়ে লাভবান হতে চেয়েছিলেন নেতানিয়াহু। হয়েছেও তাই।
পহেলা এপ্রিলে সিরিয়ার দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে হামলায় নিহত হন ইরানের সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কয়েকজন কমান্ডার। জানতেন, হামলার জবাব আসবে আয়াতুল্লাহ খামেনির সেনাদের পক্ষ থেকে। এতে জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে যুদ্ধকালীন মন্ত্রী পরিষদকে সমর্থন দিবে বিভক্ত ইসরাইলিরা। পাশাপাশি বরফ গলবে তেল আবিব-ওয়াশিংটনের মধ্যকার সম্পর্কে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মিলতে পারে রাফায় অভিযান চালানোর বিষয়ে সবুজ সংকেত। তাই গেল ২ সপ্তাহের ঘটনা প্রবাহকে নেতানিয়াহুর পলিটিক্যাল মাস্টারস্ট্রোক হিসেবে অভিহিত করছেন বিশ্লেষকরা।
কুইন্সি ইন্সটিটিউট ফর রেসপন্সিবল স্টেটক্রাফটের বিশ্লেষক ত্রিতা পারসি বলেন, 'যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করার পেছনে নেতানিয়াহুর প্রবল আগ্রহ আছে। কারণ যে মুহূর্তে যুদ্ধ শেষ হবে, তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারও ধ্বংস হবে। সম্ভবত তার কারাদণ্ড শুরু হতে পারে। তাই উত্তেজনা নিরসন, কূটনীতি কিংবা যুদ্ধবিরতিতে নেতানিয়াহুর কোন আগ্রহ নেই।'
গেল দশকে ইরানের মাটিতে ৩ পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যা করে ইসরাইল। এমনকি ২০২৩ সালের ডিসেম্বরেও ইরানের শীর্ষ জেনারেলকে হত্যা করা করা হয় সিরিয়ায়। তবে সামরিক দিক থেকে কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি খামেনি প্রশাসন। হামাস-ইসরাইল যুদ্ধের মধ্যে আঞ্চলিক সশস্ত্র গোষ্ঠীদের সমর্থন দিলেও সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে নামেনি ইরান। এতে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও বর্হিঃবিশ্বে চাপ বাড়ছিলো খামেনি প্রশাসনের ওপর। তাই প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যম হিসেবে ইরানি কনস্যুলেটে হামলার প্রতিশোধকে বেঁছে নেয় তেহরান।
যদিও পুরোদমে যুদ্ধে যেতে আগ্রহী নয় শিয়া দেশটি। হামলাকে ব্যবহার করা হয়েছে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান প্রদর্শনের মাধ্যম হিসেবে। ওয়াশিংটনকে আগেই জানানো হয়েছিলো, হামলা হবে সীমিত পরিসরে। তাই তিন শতাধিক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ব্যবহার করা হয়নি আধুনিক অস্ত্র। বিশ্লেষকরা বলছেন, উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ব্যর্থ হামলা চালিয়েছে ইরান। তবে হামলার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের অবস্থান যেমন সুসংহত হলো, ঠিক তেমনি খামেনি প্রশাসন সমর্থন পেলো জনগণের কাছ থেকেও।
স্টিমসন সেন্টারের গবেষক বারবারা স্ল্যাভিন বলেন, 'ইরান খুবই কৌশলী হয়ে হামলা করেছে। ধীরগতির ড্রোনগুলো একেবারে নিচ দিয়ে যাচ্ছিলো। এগুলোর কয়েকঘণ্টা লেগেছে ইরান থেকে ইসরাইলে পৌঁছাতে। এতে ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র ও বাকিরা অনেক সময় পায় প্রস্তুত হতে।'
সাংহাই ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফান হোঙ্গডা বলেন, 'এটা আসলে প্রতীকি হামলা ছিলো। দুরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলের জন্য হুমকি তৈরি করতে পারবে না, এ বিষয়ে ইরান জানতো। মূলত নিজেদের সক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য হামলা চালানো হয়েছে।'
উপযুক্ত সময়ে ইরানের ওপর প্রতিশোধের হুমকি দিয়েছে ইসরাইল। ইসরাইলের হামলা ঠেকাতে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে তেহরানের সশস্ত্র বাহিনী। তবে সিএনএন এর প্রতিবেদন বলছে, তেহরানে পাল্টা হামলা চালাবে না তেল আবিব। রোববার আধা ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকের পরেও কোন সুর্নিদিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি নেতানিয়াহু প্রশাসন। কারণ ইরানে হামলা না চালাতে নির্দেশনা এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে। এমন পদক্ষেপ নিবেন না, যার জন্য পরে অনুশোচনা করতে হয়; হামলার কয়েক ঘণ্টা পরই মার্কিন প্রশাসন এমন বার্তা দিয়েছে ইসরাইলকে।
নিউইয়র্ক টাইমসের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ইরান-ইসরাইল সংঘাতে লাভ হয়েছে দুপক্ষেরই। ইসরাইল পেলো যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করার লাইসেন্স, ইরান ফিরে পেলো হারানো গৌরব। ভূ-রাজনীতির মারপ্যাঁচে কপাল পুড়লো ভাগ্যহত ফিলিস্তিনিদের।