বাংলাদেশের সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের সংঘাতের শঙ্কা ছুঁয়েছে দারুচিনি দ্বীপ খ্যাত নীল জলরাশির সাগর কুমারীকেও। মিয়ানমারে জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে চলা সহিংসতার পর থেকে দফায় দফায় নিষেধাজ্ঞার কবলে পরে পর্যটক হারিয়েছে সাগরবক্ষের এই প্রবাল দ্বীপটি। নিরাপত্তা ঝুঁকিতে স্বাভাবিক সময়েও পর্যটক মেলেনি আশানুরুপভাবে।
প্রায় একইরকমভাবে পাহাড় দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন পর্যটকেরা। নানা সতর্কতায়, ২০২২ ও ২৩ সালে কয়েক দফা পর্যটক নিষেধাজ্ঞা ছিল পার্বত্যের তিন জেলায়। চলতি বছরের শুরুতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও এপ্রিলে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) ফের হামলা ঘিরে তৈরি হয় নতুন অনিশ্চয়তা। যার প্রভাব পরে প্রতিবেশি রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলাতেও। পর্যটকশূন্য হয়ে পরে পাহাড়।
সবমিলিয়ে, বাংলাদেশের পর্যটনখাত চলমান সময়ে একটা ভিন্নরকম সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে, দীর্ঘ সময়ের একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতন তার বিপরীতে ছাত্রজনতার আন্দোলনেরও একটি বড় প্রভাব পড়েছে এই খাতটিতে। বিভিন্ন হিসাব মতে, সাম্প্রতিক অস্থিরতায় কম করে ১০টি দেশের নাগরিকদের বাংলাদেশ ভ্রমণের ব্যাপারে সতর্কতা জারি করেছে।
ট্যুর অপারেটররা বলছেন, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত এই চার মাসে দেশের অভ্যন্তরে পর্যটক কমেছে ৪০ শতাংশ। নেই বিদেশি পর্যটকের দেখাও। আরও শঙ্কার বিষয় হলো, খুব শিগগিরই যে এ পরিস্থিতি ভালো হওয়ার সম্ভাবনা আছে, সেরকমও কোনো পূর্বাভাস নেই।
ইনো গ্লোব ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তসলিম আমিন শোভন বলেন, 'সিকিউরিটি রিজন বা ওভারঅল সিচুয়েশনে পর্যটকদের অনেক পার্সেন্টেজ কমে গিয়েছে। সুন্দরবন, কক্সবাজার, সিলেট বা প্রতিটি জায়গায় আমরা লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, সেপ্টেম্বর থেকে ভ্রমণের কিন্তু একটা ভালো প্রেসার থাকে। অক্টোবরে আরও বেশি থাকে। কিন্তু আমরা এবার যেটা দেখতে পারছি যে, অক্টোবর-নভেম্বর পর্যন্তও আমরা যে ভালো সিচুয়েশন দেখছি বিষয়টা কিন্তু তা না'
পর্যটন খাত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন পর্যটকের ভ্রমণের প্রধান শর্তই হলো নিরাপত্তা। পর্যটকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে দেশের পর্যটনে সহসাই গতি ফেরানো কঠিন হবে।
পর্যটন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. সন্তোষ কুমার দেব বলেন, 'যেকোনো ধরনের পলিটিক্যাল আনরেস্টে পর্যটনের জন্য নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট বয়ে আনবেই। বিশ্বের সবচেয়ে বড় সী-বিচ রয়েছে এবং বাংলাদেশে তিনটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ডেস্টিনেশন রয়েছে, সে জায়গাগুলোর প্রোপার ব্র্যান্ডিং আমরা যদি করতে পারি, তাহলেই কিন্তু আন্তর্জাতিক পর্যটকদের বেশি আকৃষ্ট করতে পারবো।'
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মহাব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণ) মো. জিয়াউল হক হাওলাদার বলেন, 'স্থানীয় জনগণ যদি পর্যটকদের ওয়েলকাম না করে তাহলে কিন্তু যতই ট্যুরিস্ট পুলিশ আর যতই নিরাপত্তার চাদরের বলয় করে রাখি না কেন পর্যটক সেখানে শান্তি পাবে না। স্থানীয়রা যদি ওয়েলকামিং হয়, হাসিমুখে তাদের খাবারটা দেয় এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা। পর্যটকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে দেশের পর্যটনে গতি ফেরানো আসলেই কঠিন হয়ে যাবে।'
দেশের প্রধান প্রধান ১২৪টি পর্যটন কেন্দ্রে পর্যটকের নিরাপত্তা দিতে কাজ করছে ট্যুরিস্ট পুলিশ। চলমান সংকট মোকাবিলায় নিরাপত্তা জোরদার করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
ট্যুরিস্ট পুলিশ বাংলাদেশের ডিআইজি মো. আবুল কালাম সিদ্দিক বলেন, 'ট্যুরিস্ট পয়েন্টে যদি কেউ কোনোভাবে হ্যারাসমেন্টের শিকার হয়, তারা তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের অবহিত করলে আমরা পদক্ষেপ নেবো। কিছুদিন আগে কক্সবাজারে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল, আমরা কিন্তু ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছি। এবং সকল ট্যুরিস্ট পয়েন্টেই আমাদের নির্দেশনা দেয়া থাকে।'
আর বাংলাদেশে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেয়া দেশগুলোকে চিহ্নিত করে সতর্কতা তুলে নিতে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের বলেন, 'দুইটা বিষয় যে, আমরা কোন কোন দেশে অ্যালার্ট আছে, সে দেশগুলো আমরা আইডেন্টিফাই করেছি। করে আমরা মন্ত্রণালয়কে বলেছি এই অ্যলার্টগুলো প্রত্যাহার করার জন্য যেন উদ্যোগ নেয়া হয়। দুইভাবে উদ্যোগ নেয়া হবে, এটা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আর একটি প্রধন উপদেষ্টার দপ্তর থেকেও হতে পারে। এই বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে।'
গেলো বছর দেশে অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সংখ্যা ছিল দেড় লাখ আর বিদেশি পর্যটক এসেছিল ৫ লাখের মতো।