২৯ ডিসেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ার মুয়ান আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে ১৮১ আরোহী নিয়ে বিধ্বস্ত হয় জেজু এয়ারের বোয়িং বিমান। ২ ক্রু বাদে প্রাণহানি হয় বাকি ১৭৯ আরোহীর।
ল্যান্ডিং গিয়ারে জটিলতার কারণে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে থাকতে পারে- এমন পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি আলোচনায় আসে পাখির ঝাঁকের ধাক্কা বা বার্ড স্ট্রাইক প্রসঙ্গ। এমনকি, কাজাখস্তানে আজারবাইজানি এয়ারলাইন্সের বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় মস্কো ভুল স্বীকার পর্যন্ত এই দুর্ঘটনার কারণ বলা হচ্ছিল বার্ড স্ট্রাইক।
যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইয়ো স্টেট ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর অ্যাভিয়েশন স্টাডিজের তথ্য বলছে, বিমানের ইঞ্জিন, ককপিটের জানালা কিংবা চালকের সামনের গ্লাসে পাখির ধাক্কা লাগা খুব সাধারণ ঘটনা। প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রের আকাশসীমায় গড়ে অন্তত ১৪ হাজারের বেশি বার্ড স্ট্রাইকের ঘটনা ঘটে।
১৯৯০ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত গেল ৩৪ বছরে ঘটে যাওয়া বার্ড স্ট্রাইক নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন ব্রডকাস্টিং সংস্থা এনপিআর। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল অ্যাভিয়েশন অ্যাসোসিয়েশন, এফএফএ'র ডাটাবেজের তথ্যের বরাতে এনপিআর জানাচ্ছে, ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত ৭১৩ বিমানবন্দরে মোট ১৯ হাজার ৪শ' বার্ড স্ট্রাইকের ঘটনা ঘটে। ঐ একই বছরে বিশ্বের ৫৫টি দেশের ৯২টি বিমান বন্দরে ঘটে যাওয়া বার্ড স্ট্রাইকের সংখ্যা ২৩৬।
এফএএ আরও জানায়, ১৯৮৮ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে পাখি, হরিণ বা অন্যান্য প্রাণীর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বিমানের সংখ্যা সাড়ে তিনশতাধিক। এসব বন্যপ্রাণীর কারণে বেসামরিক ও সামরিক বিমান বিধ্বস্ত হয়ে গেল ৩৫ বছরে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৪৯১ জন আরোহী।
মার্কিন অ্যাভিয়েশন অ্যাসোসিয়েশন আরও বলছে, যে সব বিমান বার্ড স্ট্রাইকের কবলে পড়ে তার ৬১ শতাংশ ঘটে অবতরণের সময়, ৩৬ শতাংশ উড্ডয়নের সময় আর উড়ন্ত বিমানে ঘটে যাওয়া বার্ড স্ট্রাইকের।
অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, আধুনিক যে কোনো বিমান বাজারে ছাড়ার আগে ওয়াল্ডলাইফ স্ট্রাইকের ক্ষয়ক্ষতি দিকগুলো যাচাই করে নেয়ার বিধান কার্যকর করেছে মার্কিন প্রশাসন।
২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হাডসন নদীতে ইউএস এয়ার ওয়েসের বিমান হাঁসের ঝাকের কবলে পড়ে, এসময় দু'টি ইঞ্জিন বিকল হলেও দুর্ঘটনা ঘটেনি। যদিও, আর্থিক ক্ষতি বিবেচনা করলে পরিযায়ী পাখির ঝাঁক বিড়ম্বনার কারণ হতে পারে। ১৯৯০ থেকে ২০১৯- বার্ড স্ট্রাইকের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বিমান মেরামতে ৫০ কোটি ডলার গুনতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের।
পাখির মতো বিমান বা হট এয়ার বেলুনেরও বিচরণ ক্ষেত্র আকাশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানুষের সুবিধার্থে আকাশ থেকে পক্ষীকূল সরানো কোনো সমাধান না হলেও, নেয়া যেতে পারে কিছু আগাম পদক্ষেপ।
যে সব বিমানবন্দর চারণ ভূমি বা জলাশয়ের পাশে নির্মিত সেখানে প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের সাথে বিমানের সংঘর্ষ এড়ানোর সুযোগ কম। কাজেই বিমানবন্দরের ভৌগোলিক অবস্থান পুনর্বিবেচনা ওয়াইল্ড লাইফ স্ট্রাইকের প্রথম সমাধান।
এছাড়া, হাডসন নদীর ঐ বার্ড স্ট্রাইকের পর কয়েক মিলিয়ন ডলার খরচ করে বিমানবন্দরের আশেপাশের পশুপাখিদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের উদ্যোগ নেয় মার্কিন প্রশাসন। পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা বিভাগে নিয়োগ দেয়া হয় বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞদের।
এছাড়া, শীতকালে সাইবেরিয়ার মতো দেশ থেকে তুলনামূলক উষ্ণ পরিবেশে পাড়ি দেয় পরিযায়ী পাখির দল। কাজেই অক্টোবরের শেষ থেকে মার্চের শুরু পর্যন্ত এই অতিথি পাখিদের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রয়োজনের লেজার লাইট ও শব্দ গ্রেনেড ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।
স্কাই ব্রারির পর্যবেক্ষণ বলছে, যেহেতু অধিকাংশ বার্ড স্ট্রাইক বিমান অবতরণের সময় ঘটছে, ল্যান্ডিং গিয়ারের ত্রুটি এড়াতে, বিকল্প ল্যান্ডিং মেকানিজম ব্যবহারের কথা ভাবছে প্রযুক্তি নির্মাতারা।
প্রয়োজনে জরুরি অবরতণের জন্য বিমানচালক ও ক্রুদের আলাদা প্রশিক্ষণ দেয়ার পাশাপাশি পাখির ঝাঁকের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য বিশেষ উইং গঠনের কথা ভাবছে বোয়িং এর মতো প্রতিষ্ঠানও।