দুপুর গড়িয়েছে। এখনও পেটের আগুন নেভেনি বাস চালক রফিকুল ইসলামের। ২০ টাকার আলু,২০ টাকার শাক আর ভাতের সাথে ডাল এখনও উনুনে। আয় ব্যয়ের ফারাকের তার মেলাতে বছর দুই আগেই পরিবার গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। হোটেলের খাবারের দামও ছুঁয়েছে আকাশ। তাই ভরসা উনুনেই।
বাস চালকের সিটে বসলেই প্রতিদিন আয় ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। এ পকেট ও পকেট দিয়ে শূন্য হাতেও ঘরে ফিরতে হয় রফিকুলকে। মালিকের বেঁধে দেয়া ৩ হাজার টাকা জমার সাথে তেল খরচ ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার। হিসেবটা এমন হলে হয়তো জীবন নিয়ে এতো আক্ষেপ থাকতো না তার। জটিলতা চাঁদার টাকা নিয়ে।
তিনি বলেন, 'একদিন গাড়ি না চালালে বেতন পাবো না। আর এতে সন্তানরাও খাবার পাবে না।'
জীবন হিসেবের এমন জটিল সমীকরণে আরও কারা আছে দেখতে চায় এখন টিভি। শুরুটা রাজধানী দিয়ে করতে চাই। চাঁদাবাজির চাপে অতিষ্ট অধিকাংশ বাস মালিক-চালক।
একজন বাসের চালক বলেন, 'সিগন্যাল পড়লেই ২শ’ টাকা করে দিতে হবে। চাঁদা দিয়ে আমার তেলের টাকা এখন পর্যন্ত নেই।'
ভারতের ইঞ্চিনে বাংলাদেশে বানানো কাঠামো লাগিয়ে তৈরি হয় দেশের অধিকাংশ বাস। নিবন্ধন নিয়েই জীবনের গল্প শুরু হয়ে যাত্রীবাহী বাসের। উৎকোচ না দিলে নিবন্ধন নিতেই পড়তে হয় হয়রানির মুখে। এর পর বছর বছর ফিটনেস সার্টিফিকেটের জন্য শুরু হয় দৌড়ঝাপ।
অনেকটা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চাঁদাবাজি হচ্ছে খুলনায়। চাঁদা বাজি এখানে ওপেন সিক্রেট। খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর মোড়। শ্রমিক ইউনিয়নের নামে এখান থেকে তোলা টাকা না দিয়ে যাওয়ার উপায় নেই কারো। সবাই জানে মুখ খোলে না কেউ।
শ্রমিক ইউনিয়নের নামে চাঁদা তোলা ব্যক্তি বলেন, 'আমরা ৩০ টাকা করে নেই। ইউনিয়ন ১০ টাকা আর বাকি টাকা মালিক সমিতি নিয়ে থাকে।'
এখন টেলিভিশনের পাওয়া তথ্য বলছে, সোনাডাঙ্গা থেকে যশোর রুটে গাড়ি চলতে ৫টি স্থানে চাঁদা দিতে হয়। সাতক্ষীরা রুটে গাড়ি চললে ৪ টি স্থানে, পাইকগাছা রুটে ৪টি স্থানে এবং বাগেরহাটে গাড়ি চললে ২টি স্থানে চাঁদা দিতে হয় শ্রমিক ইউনিয়নের নামে। এসব স্থানে চাঁদার হার ১০টাকা থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত। এছাড়া ঢাকা রুটে গাড়ি চললে শ্রমিক ইউনিয়নের নামে ৫০টাকা এবং রুট কমিটির নামে ৬০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। হিসেব অনুযায়ী প্রতিদিন চাঁদা দিতে হচ্ছে।
একজন চালক বলেন, 'একটা স্লিপে ৪১০ টাকা নিয়ে থাকে। বিভিন্ন বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে বিভিন্ন দামে টাকা নিয়ে থাকে।'
আরেকজন বলেন, 'এই যে রুটে যেই বাসগুলো চলে তার কোনো মালিক সমিতি নেই। রুটে এখন গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করছে রাজনৈতিক নেতারা।'
ব্যবসায়ীক নগরী হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামের অবস্থা একই রকম। এখানে রীতিমতো চাঁদাবাজির ঘটনা বলতে ভয় পায় অধিকাংশ বাস মালিক ও চালক। শহরে চলা অধিকাংশ গাড়ির নেই রুট পারমিট, ফিটনেস সার্টিফিকেট কবে নিয়েছেন তারও নেই হদিস।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটিন পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি বেলায়েত হোসেন বেলাল বলেন, 'ট্রাফিক বিভাগ যদি আগামী তিন মাস পরিবহনের কাছ থেকে টাকা নিবে না। তারা যদি বলে কোনো অবৈধ কাজ করতে দিবো না, কোনো ফিনটেসবিহীন গাড়ি চলতে দিবো না। তাহলে দেখবেন চট্টগ্রাম শহর পরিষ্কার হয়ে যাবে।'
চট্টগ্রাম নগরীতে বাস মিনি বাসের জন্য রুট রয়েছে ১৭। অনুমোদিত বাসের সংখ্যা ১ হাজার ১৩০ টি। হিউম্যান হলারের জন্য ১৮ টি রুট রয়েছে, সেখানে ৯৫৯ টি যানবাহনের রুট পারমিট রয়েছে। অটো-ট্যাম্পুর জন্য ২১ টি রুটের অনুমতি দেয়া আছে যেখানে ২ হাজার ১৯৩ টি যানবাহন চলাচল করতে পারে। বাস্তবে এর চেয়েও বেশি যানবাহন চলছে সড়কে। যারা চলছে প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই।
টিআইবির গবেষণা বলছে, দেশের আন্তঃজেলা-দূরপাল্লা রুটের বাসের ক্ষেত্রে বাস প্রতি গড় ঘুষের পরিমাণ ১ হাজার ১৯ টাকা, আন্তঃজেলা-আঞ্চলিক রুটের বাসের ক্ষেত্রে ১ হাজার ১৩৩ টাকা এবং সিটি সার্ভিসের বাসের ক্ষেত্রে গড় ঘুষের পরিমাণ ৫ হাজার ৬৫৬ টাকা। বছরের হিসেবে ১ হাজার ৬০ কোটি টাকা গুনতে হয় পরিবহন খাত সংশ্লিষ্টদের।
টিআইবি'র পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'আমরা যে হিসাব দিচ্ছি তা কম বাস্তবে এর থেকেও বেশি। এখানে চাঁদাবাজি সড়ক পথে স্বাভাবিক করে ফেলা হয়েছে। ফলে এর প্রভাবটা দ্রব্যমূল্য ও সেবাখাতের উপর পরে। আর এর দ্বিতীয় দফায় প্রভাব পরে জনগনকেই এর বোঝা বইতে হয়।'
টিআইবির গবেষণার থেকেও ভয়াবহ চিত্র বাস্তবে। পণ্য পরিবহনের চাঁদাবাজির চিত্র ছিল না টিআইবির গবেষণায়। অভিযোগ রয়েছে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, মালিক সমিতি, শ্রমিক সংগঠন, পুলিশ, সবাই নেয় টাকা এই খাত থেকে।
ট্রাক চালক একজন বলেন, 'ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন হাবিজাবি বিভিন্ন নামে চাঁদা তুলছে। প্রত্যেক জায়গাতেই আমাদের টাকা দিতে হয় কোথাও কোথাও ৫০ থেকে ৩শ’ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়।'
আরেকজন বলেন, 'চাঁদা না দিলে এরা হয়তো গ্লাস ভেঙ্গে ফেলে নয়তো লুকিং গ্লাস ভেঙ্গে ফেলে আর এতে করে বাধ্য হয়ে চাঁদা দিতে হয়।'
সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজির কারণে কৃষকের উৎপাদিত পণ্য কম দামে পায় না ভোক্তা অভিযোগ দোকান মালিক সমিতির।
দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, 'যদি আমরা এই অপ্রাতিষ্ঠানিক চাঁদাবাজি বন্ধ করতে পারতাম তাহলে নিঃসন্দেহে সারাদেশ থেকে ১ থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করতে পারতাম।'
বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান ড্রাইভার্স ইউনিয়নের সভাপতি তালুকদার মো. মনির বলেন, সকল জায়গায় পণ্য পরিবহনে ট্রাকের ভাড়া বৃদ্ধি হয় এই চাঁদাবাজির কারণে। রাস্তায় রাস্তায় এসব চাঁদাবাজি চলে।'
মাত্র ৩ মাসে চট্টগ্রাম থেকেই চাঁদাবাজির ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছে ৪৫ জন। র্যাবের দায়িত্বশীলরা বলছে শুধমাত্র কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকাতেই মাসে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকার চাঁদাবাজি হয়। এই টাকার ভাগ যায় সব টেবিলে। ফলে বাড়ে পণ্যের দাম সাথে যাত্রী ভাড়া তো আছেই।
অননুমোদিত ও ফিটনেসবিহীন বাস চলাচলে দৈনিক ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। এসব চাঁদা আদায় করেন প্রভাবশালীরা। ভাগ পান প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলাবাহিনী সদস্যরাও। চাঁদা আদায়ের অভিযোগে ফেব্রুয়ারি থেকে তিন মাসে ৪৫ জনকে আটক করেছে র্যাব। বাহিনীটির তথ্যমতে নগরীতে ৩০ টির বেশি স্থানে মাসে ৩০ থেকে ৪০ কোটি টাকার চাঁদা নেয়া হয়।
চট্টগ্রাম র্যাব-৭ অধিনায়ক লে.ক. মো. মাহবুব আলম বলেন, 'যেসব স্থান মূলত ব্যস্ততম জায়গা সেখানেই চাঁদাবাজি হয়ে থাকে। আমরা যখন অভিযান করি তখন দেখতে পায় এদের চাঁদা তোলার কোনো বৈধতা নেই।'
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, 'তারা যে সার্ভিস চার্জ নেই তা যেন নিদিষ্টভাবে যেন নেই। যখন তারা এইটা নেই না তখন আমরা বিড়ম্বনার শিকার হয়ে যাচ্ছি যা চাঁদাবাজি। সড়কে যখন পুলিশ ফিটনেস পরিক্ষা করে তখন এইটা চাঁদাবাজির অংশ না। আমাদের পুলিশ চাঁদাবাজি যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে।'
পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন বলেন, 'আমরা আশ্বস্ত করতে চায় কোন অকারণে অহেতুকভাবে কোনো যান চলাচল বন্ধ করা হবে না। '
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তপক্ষের দেয়া তথ্য অনুযায়ী , ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত মোট নিবন্ধিত যাত্রীবাহী বাস ও মিনিবাসের সংখ্যা ছিল ৮১ হাজার ৭৭৭টি, যার মধ্যে বাসের সংখ্যা মোট ৫৩ হাজার ৬৫৬টি এবং মিনিবাসের সংখ্যা ২৮ হাজার ১২১টি। বর্তমানে বিআরটিএ হতে নিবন্ধিত বাসের ৭০ শতাংশ ঢাকায় নিবন্ধিত। অপরদিকে, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন এর বাসের সংখ্যা নগণ্য যা সড়কে চলাচলকারী বাসের ১.৬ শতাংশ। অনিবন্ধিত বাসের ক্ষেত্রে কি ব্যবস্থা নিচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মাদ মজুমদার বলেন, 'জুনের পরে আমরা মাঠে নামবো যেন কোনো ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলতে না পারে। '
২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে সড়ক ও পরিবহন খাতের উন্নয়নের বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৩৪ হাজার ৬২ কোটি ২১ টাকা, যা মোট বাজেটের ৪.৫ শতাংশ। তবুও দেশের ৬০.২ শতাংশ মানুষের ন্যায্যমূল্যের ভ্রমণ হাতের বাইরে। কোথায় সমাধান?
মন্ত্রী থেকে কর্তৃপক্ষ। চাঁদাবাজি থামাতে পদক্ষেপ নিয়েছে এমন দাবি সবার। তবুও কেন অজানা কারণে চাঁদাবাজি থামছে না। কার শক্তিতে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞাও আমন্য করছে সিন্ডিকেট? সেটা খুঁজে বের করা সময়ের দাবি মাত্র।