ভারি, ঘন আর বিষাক্ত বাতাসে ছেয়ে আছে পাকিস্তানের আকাশ। দূষণের মাত্রা এতোটাই ভয়াবহ যে সুদূর মহাকাশ থেকেও তা দৃশ্যমান। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা'র ওয়ার্ল্ড ভিউয়ে স্পষ্ট পাঞ্জাব প্রদেশের ওপর ধোঁয়াশার পুরু আস্তর।
ভারত সীমান্তবর্তী পাঞ্জাবের প্রাদেশিক রাজধানী লাহোর। দেড় কোটি মানুষের বসতি আর কলকারখানায় ঠাসা দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ নগরী। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নগরীর তালিকায় নিয়ম করে নাম উঠলেও চলতি মাসে রেকর্ড ছুঁয়েছে লাহোরে বায়ুদূষণের মাত্রা। টানা প্রায় দু'সপ্তাহ দূষিত শহরের বৈশ্বিক তালিকায় শীর্ষে তো আছেই, এর মধ্যে গেল শুক্রবার বায়ুমান সূচক ১৯শ'তে পৌঁছালে চমকে যায় বিশ্ব। এরপর সপ্তাহখানেক পেরিয়ে স্থানীয় সময় আজ (মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর) ভোরেও এ সংখ্যা ছিল এক হাজারের ওপর; যেখানে বেঞ্চমার্ক হিসেবে ৩শ' পার করাই বিপজ্জনক বলে মাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
বাসিন্দাদের একজন বলেন, ‘ধোঁয়াশা পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল। শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা এড়াতে আমরা মাস্ক পরতে বাধ্য হচ্ছি।’
আরেকজন বলেন, ‘আমি শ্বাসকষ্টে ভুগছি। চোখে পানি আসছে। বাতাসের মান খারাপ বলেই হয়তো। বাইরের পরিবেশ নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত ঘরেই থাকবো।’
প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ধাতব কণা পিএম টু পয়েন্ট ফাইভের পরিমাণ ৯৪৭ মাইক্রোগ্রাম, যা নিরাপদ সীমার ১৯০ গুণ। এ অবস্থায় রাস্তায় বেরোলেই ধোঁয়া চোখে কাঁটার মতো বিঁধছে, বাতাসে শ্বাস নিলে জ্বলছে গলা। রাস্তাঘাট, হাঁটা দূরত্বের ভবন থেকে শুরু করে ঐতিহাসিক স্থাপনা- সবই দৃষ্টিসীমার বাইরে, দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে জনজীবন বিঘ্নিত। দূষণের তীব্রতায় ঘরের ভেতরেও মিলছে না শান্তি; বন্ধ দরজা-জানালার ভেতর দিয়ে যেটুকু বাতাস ঢুকছে, তা থেকেও দূষিত বায়ুকণার ক্ষতি কমাতে ব্যয়বহুল এয়ার পিউরিফায়ার কেনার মতো সামর্থ্য আছে কম মানুষেরই।
দূষণের ভয়াবহতায় রাজ্যের এক কোটি ১০ লাখ শিশু স্বাস্থ্যঝুঁকিতে, সতর্কতা জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের। দূষণের কারণে শ্বাসপ্রশ্বাসের জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে ৪০ হাজারের বেশি মানুষ; গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি এক হাজারের বেশি মানুষ। এ অবস্থায় লাহোরের পাশাপাশি মুলতান, গুজরানওয়ালা, ফয়সালাবাদসহ বায়ু মান সূচক ৫শ'র বেশি- এমন বিভিন্ন শহরে জনজীবনে দূষণের প্রভাব কমাতে যুদ্ধকালীন জরুরি ব্যবস্থার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে রাজ্য সরকার।
পাকিস্তানের ধোঁয়াশাবিরোধী যুদ্ধকালীন কার্যালয়ের উপ-পরিচালক ও মুখপাত্র নোমান ইউনূস বলেন, ‘ধোঁয়াশা আঞ্চলিক সমস্যা। তবে আমাদের সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেয়ার কারণে ধোঁয়াশার ক্ষতিকর প্রভাব কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আছে। দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে বাতাসের মান আজ আরও অনেক বেশি খারাপ থাকতো। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের চেষ্টা কিছুটা হলেও কাজে দিচ্ছে।’
দূষণের কারণ হিসেবে ইটের ভাটা, কলকারখানা আর যানবাহনে নিম্নমানের জ্বালানি ব্যবহার, কৃষি জমিতে আগাছা পোড়ানোকে দায়ী করা হচ্ছে। শীতে কম তাপমাত্রা আর ধীর গতির বাতাসের কারণে দূষিত বাতাস সরে যেতে পারে না। শ্বাসনালীর রোগের পাশাপাশি মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, হৃদ্রোগ, ফুসফুসে ক্যান্সারসহ মানবদেহে বিভিন্ন প্রাণঘাতী রোগ বাসা বাঁধতে পারে বায়ুদূষণের কারণে। সবচেয়ে ঝুঁকিতে নবজাতক, শিশু ও বয়স্ক জনগোষ্ঠী। দূষণ নিয়ন্ত্রণে গেলো বছর কৃত্রিম বৃষ্টি, এ বছর জলকামান আর ট্রাক দিয়ে রাস্তায় পানি ছিটিয়েও স্থায়ী কোনো সুফল মেলেনি।