শিল্প-কারখানা
অর্থনীতি
0

অধিকাংশ বিসিক শিল্পনগরীর রুগ্ণ দশা; কোনোমতে ব্যবসা করছেন উদ্যোক্তারা

উদ্যোক্তা তৈরি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান (বিসিক)। তবে স্বাধীনতার এতো বছর পরও ঢাকাসহ কয়েকটি জেলার বিসিক শিল্পনগরীর অবকাঠামোর চিত্র রুগ্ণ। সেখানকার ব্যবসায়ীদের দাবি, নিজ উদ্যোগেই তারা ব্যবসা করে যাচ্ছেন। আর শিল্পমন্ত্রী বলছেন, নতুন করে সাজানো হবে বিসিক শিল্প নগরীগুলোকে। সহজ শর্তে ঋণ, সরাসরি রপ্তানির সুযোগ, শতভাগ প্লট বরাদ্দ নিশ্চিত করতে পারলে বিসিক শিল্প নগরী হতে পারে দেশের অর্থনীতির অন্যতম চাবিকাঠি এমনটা মত অর্থনীতিবিদদের।

বগুড়া বিসিক শিল্পনগরীতে উৎপাদনে আছে ৪৮টি প্রকৌশল শিল্প। যেখান থেকে পূরণ হচ্ছে দেশের মোট চাহিদার ৭০ ভাগ কৃষি যন্ত্রাংশ। প্রকৌশল শিল্পসহ সর্বমোট ৯০টি শিল্প ইউনিট থেকে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বার্ষিক উৎপাদন। যেখান থেকে সরকারের রাজস্ব ১৭০ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।

প্রতিষ্ঠার পর ১৯৮৩ সালে বগুড়া শিল্প নগরীর সম্প্রসারণ হয়, চাহিদা থাকলেও এরপর আর কলেবর বাড়েনি। তবে বগুড়ায় দ্বিতীয় বিসিক শিল্পপার্ক প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব একনেকে ঝুলে আছে দীর্ঘদিন।

বগুড়া বিসিকের উপমহাব্যবস্থাপক একেএম মাহফুজুর রহমান বলেন, 'বগুড়ায় দক্ষ শ্রমিক আছে, দক্ষ উদ্যোক্তা আছে। যেটা অন্য এলাকায় পাওয়া যাবে না। আমাদের এখানে যে পরিমাণ সফল উদ্যোক্তা আছে তা অন্য কোনো এলাকায় নেই। কিন্তু তাদের আমরা চাহিদা মোতাবেক সুযোগ দিতে পারছি না।'

বগুড়া বিসিকে উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্য দেশে বাজারজাত করা হলেও বিদেশের বাজারে খুব একটা জায়গা করতে পারেনি এখনও। গত অর্থবছরে শুধু ওষুধ রপ্তানি থেকে এসেছে ৭ কোটি টাকা। আর ভারতে সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প রপ্তানি করে আয় ৪ কোটি ২০ লাখ টাকা। তবে এখনও উৎপাদিত বিভিন্ন যানবাহনের ফিল্টার বিভিন্ন দেশে সুনাম অর্জন করলেও নানা কারণে রপ্তানি এখন বন্ধ আছে।

ফাউন্ড্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি আব্দুল মালেক আকন্দ বলেন, 'কিছু পণ্যের চাহিদা ইউরোপে ব্যাপক। কিন্তু এই পণ্যের ইউরোপের পুরো মার্কেট ধরে আছে ভারত। আমরা শুরু করলে আশা করি আমাদের পিছু হটতে হবে না।'

বগুড়া মটরস লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক নূরুল ইসলাম বলেন, 'রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর কী নির্দেশ আছে বা কীভাবে কী করতে বা বিসিক আমাদের জানাতে পারবে। কাজেই যেভাবে এগোনো দরকার সেভাবে এগিয়ে যান, বিসিক আমাদের পরামর্শ দেবে।'

উদ্যোক্তারা বলছেন, বিদেশে বিসিকে উৎপাদিত এসব পণ্যের বাজার ধরার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়তে হয় তথ্য ঘাটতি নিয়ে। সেক্ষেত্রে বিসিক এবং রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর মধ্যে একটি সমন্বয় এখন অনেক বেশি জরুরি।

এতো দেশের উত্তরাঞ্চলের বিসিকের চিত্র। উপকূলীয় অঞ্চলের বিসিকগুলোর কী অবস্থা?

'অর্থনীতির ভিত মজবুতকরণের মধ্য দিয়ে সন্ধ্যা নদীর জনপদ আলোকিত হবে'- স্বরূপকাঠিতে যখন বিসিক শিল্পনগরী গড়ে ওঠে প্রত্যাশাটা এমনই ছিল।

তবে পিরোজপুরে বিসিক শিল্প নগরী প্রতিষ্ঠার ৬২ বছর পরেও সেই প্রত্যাশায় গুড়েবালি। অর্থনীতিতে গতি আনা তো দুরের কথা ৮৬ বিঘার শিল্প নগরীজুড়ে এখন শুধুই হতাশার ছাপ।

বিসিক শিল্প নগরীতে নির্দিষ্ট সীমানা প্রাচীর না থাকায় বহিরাগতদের অবাধ চলাফেরার কারণে প্রায়ই ঘটছে চুরি-ডাকাতি। অকার্যকর ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে সামান্য বৃষ্টিতেই পোহাতে হয় দুর্ভোগ। এছাড়া জলাবদ্ধতা, বিশুদ্ধ পানি সংকট ও যোগাযোগের অসুবিধাসহ নানামুখী সংকটে জর্জরিত পিরোজপুর জেলার একমাত্র শিল্প নগরীটি।

একজন শ্রমিক বলেন, 'এদিকে পথঘাট ভালো না। বিসিক এলাকার তিন অংশে তিনটা গেট হলে ভালো হয়। আমরা নিশ্চিন্তে থাকতে পারবো। বিদ্যুৎও ঠিকমতো থাকে না।'

চার ক্যাটাগরির ১৬৯টি প্লট বরাদ্দ নিয়েছে ১১০টি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। যেখানে কাগজে-কলমে ৯৯টি প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে থাকলেও বাস্তবে খালি পড়ে আছে বেশিরভাগ প্লট। কোনো কোনো প্লটে কারখানার নামে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখলেও বাস্তবে নেই কোনো কার্যক্রম।

পিরোজপুর বিসিকের সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, 'আমাদের আরডি ইতোমধ্যে বিসিক শিল্পনগরী, স্বরূপকাঠিতে পরিদর্শন করেছেন। আমরা বিসিকের কর্মকর্তারা তাকে এ বিষয়গুলো জানিয়েছি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ধাপেধাপে এই বিষয়গুলো সমাধান করা হবে।'

স্বরূপকাঠি বিসিক শিল্প নগরীতে বনজ শিল্প উৎপাদনে ৫০টি প্রতিষ্ঠান, পাট ও পাটজাত উৎপাদনে ২৩টি প্রতিষ্ঠান,ঔষধ ও রসায়নে ৬টি প্রতিষ্ঠান ও কাঁচা সিরামিক উৎপাদনে ৩টিসহ বিভিন্ন শিল্পে মোট ৯৯টি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন করছে। বিসিকের তথ্য অনুযায়ী বছরে ১৫০ কোটি টাকার বেশি পণ্য বিক্রি হয় স্বরূপকাঠি শিল্পনগরী থেকে।

পিরোজপুর সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আরিফিন আরিফ বলেন, 'পিরোজপুরের ১২ লাখ মানুষ, এতো সুন্দর একটা ভৌগোলিক অবস্থান থাকা সত্ত্বেও এখানে কোনো মাঝারি ধরনের শিল্প কারখানাও নেই।'

এদিকে ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় হোসিয়ারি বিসিক শিল্প নগরী। যেখানে কর্মসংস্থান হয়েছে সর্বোচ্চ ২ লাখ মানুষের। ৫৮.৫২ একর জমির এ শিল্পনগরীতে শিল্প প্লটের সংখ্যা ৭৪১। বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৭৪০টি। প্রায় বেশির ভাগ শিল্প ইউনিটই কার্যকর ভূমিকা পালন করছে।

বিসিক শিল্প নগরীর বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে শিল্প কারখানা থেকে উৎপাদিত পণ্যের বিক্রয়মূল্য প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা। আর ৯৩৪টি রপ্তানিমুখী শিল্প কারখানা থেকে প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকার পণ্যের রপ্তানি করা হয়। বিসিকের শিল্প নগরী থেকে ৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকার শুল্ক, কর, ভ্যাট ইত্যাদি সরকারের কোষাগারে জমা হয় । এসব কিছুর মাঝেও উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের রয়েছে বেশ কিছু সমস্যা। তাদের দাবি, নিজ উদ্যোগেই রপ্তানি করছেন তারা। এ ক্ষেত্রে বিসিকের ভূমিকা নেই বললেই চলে।

বিসিক শিল্প মালিক সমিতির ভাইস-প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম বলেন, 'বিসিকের কর্মকর্তা যারা আছেন, তাদের আন্তরিকতার অভাব আছে। তাদের সিদ্ধান্তহীনতাও একটা কারণ। সিদ্ধান্ত নিতে অনেক দেরি করে তারা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য একটা ভালো উদ্যোগ বিসিক। সেখানে এতো জটিলতা তৈরি করে রাখলে হবে না।'

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সাথে বিসিকের যোগাযোগের অভাব লক্ষণীয়। যার প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে।

অর্থনীতিবিদ সায়মা হক বিদিশা বলেন, 'পোশাক শিল্প ও প্রবাসী শ্রমিকদের আয়ের পর সবচেয়ে বড় খাত হলো কুটির শিল্প। এর যে আয় বা যেভাবে ব্যবহার হওয়া দরকার তা আমরা ব্যবহার করতে পারছি না। ছোট ছোট ব্যবসা যারা করেন, তাদের ঋণের ক্ষেত্রে সুদের হার খুব কম রাখতে পারে।

নারায়ণগঞ্জ বিসিকের উপ-মহাব্যবস্থাপক জসিম উদ্দিন বলেন, 'নারায়নগঞ্জের আবাসিক এলাকা আর ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন সব মনে হয় এক হয়ে গেছে। এখানে বেশিরভাগই নতুন রাস্তা হয়ে আসছে। এবং আরও কিছু নতুন রাস্তা হবে। ভেতরের কিছু রাস্তা আছে যেগুলো একটা সমস্যা হচ্ছে। সেগুলোও আমরা করে ফেলবো।'

১৯৫৭ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের হাত ধরেই 'ইপসিক' যা বর্তমান বিসিক প্রতিষ্ঠা লাভ করে। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশজুড়ে নতুন নতুন শিল্প গড়ে তোলা। তবে স্বাধীনতার এতো বছর পরেও অবহেলিত বেশিরভাগ বিসিক শিল্প নগরী। অপ্রতুল বরাদ্দ সংকটের মূল কারণ বলছেন বিসিক কর্মকর্তারা। তবে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বিসিকের কার্যক্ষমতা অনেক বেশি বলে দাবি করছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটি শিল্প করপোরেশন।

বিসিক পরিচালক কামাল উদ্দিন বিশ্বাস বলেন, ' এ বছর আমরা প্রায় ৫০টির মতো বিসিক আমরা মেরামত করে ফেলছি। প্লট অ্যালোটমেন্ট পলিসি ২০২৩ তৈরি করা হয়েছে। এখন এগুলো কেই তৈরি করতে না পারলে আমরা এগুলো বাতিল করে নতুন করে উদ্যোক্তাদের তৈরি করার চেষ্টা করছি।'

শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের আশ্বাস- বিসিককে নতুন করে সাজানোর পরিকল্পনা করছে সরকার।

তিনি বলেন, 'পুরোনো বিসিকগুলোর উন্নয়ন সেভাবে আর হয়নি। ফেস-১ এ আমরা যে জায়গা পাচ্ছি, সেখানে আমরা বর্ধিত অংশেও যাচ্ছি। পুরোনোগুলো একেবারে পাকিস্তান আমল থেকে শুরু হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। নতুন করে দরকার। আমরা অতিসত্ত্বর এগুলোতে কাজ শুরু করবো। যদিও কিছু জায়গায় কাজ শুরু হয়েছে।'

পরিবেশবান্ধব ও পরিকল্পিত শিল্পায়নের মাধ্যমে বিসিকে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকারত্ব দূরীকরণ সম্ভব- মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এমএসআরএস

এই সম্পর্কিত অন্যান্য খবর