২০১২ সালের অক্টোবর থেকেই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সব শক্তির উৎসে ছিলেন নাজমুল হাসান পাপন। ২০১৩ সালে প্রথমবার নির্বাচনে একক প্যানেল গঠন করে জয়ী হয়েছিলেন তিনি। সেবার সাবেক বিসিবি সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী সরে যাওয়ার পর আর কেউ তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি।
পরের দুই নির্বাচনেও ছিল তার এই ক্ষমতার আধিপত্য। বিসিবির গঠনতন্ত্রে সহ-সভাপতি রাখার কথা থাকলেও কার্যত সেটা কখনোই রাখেননি তিনি। এরপর টানা ১২ বছর সভাপতি থাকার সময় ক্রিকেট বোর্ডের প্রায় সবখানেই নিজের পছন্দের লোক বসিয়েছেন পাপন।
ক্রিকেটের উন্নয়নে যেকোনো কিছু দ্রুত করে ফেলার ক্যারিশমাটিক ক্ষমতা ছিল তার। কিন্তু বিসিবি বস চেয়ারে বসে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনাময় ক্রিকেটকে ধ্বংসের 'গুরুতর অভিযোগ' আছে পাপনের বিরুদ্ধে। যে ক্রিকেটকে ভালোবেসে এদেশের কোটি কোটি মানুষ এক ভাবনায় ছিল, দলের মধ্যে ছিল ঐক্যমত। সেখানেও ফাটল ধরানোর কারিগর ছিলেন পাপন। দলের মধ্যেও বিভেদ চরমে ওঠে।
আরও পড়ুন পদত্যাগ করেছেন বিসিবি সভাপতি পাপন, নতুন সভাপতি ফারুক আহমেদ
জাতীয় দলের জন্য 'ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগ' থাকলেও কিন্তু কোচ থেকে শুরু করে নির্বাচক সব সিদ্ধান্তই আসত বিসিবি সভাপতির কাছ থেকে। এমনকি দল গঠন, টসের সিদ্ধান্ত, টিম মিটিং—সবকিছুতেই তার ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। এমনকি এগুলো নিয়ে গণমাধ্যমেও প্রকাশ্যেই বড়াইও করেছেন তিনি। এতে করে ক্রিকেট এগোনোর চেয়ে বেশি যে পিছিয়ে গেছে, সেটা এখন জাতীয় দলের পারফরম্যান্সই বলে দিচ্ছে।
বিসিবির বাইরেও একাধিক বিসিবি অফিস গঠন করেছিলেন পাপন। কখনও বেক্সিমকো ফার্মার অফিসে, কখনও বা নিজের বাসভবন থেকে বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিতেন তিনি। তামিম ইকবালকে ঘিরে যত নাটকীয়তা, টেস্ট থেকে মুমিনুল হকের অধিনায়কত্ব কেড়ে সাকিব আল হাসানকে নেতৃত্ব দেয়া, সব সিদ্ধান্তই এসেছে পাপনের বাসভবনে। বিসিবির নিজস্ব কার্যালয় থাকার পরও বোর্ডের জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিজ বাসায় কিংবা অফিসে বসেই নিতেন পাপন।
পাপনের এক যুগে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ ক্রিকেটের অর্জন আশানুরূপ না হলেও ব্যাংক ব্যালেন্স ফুলে ফেপে উঠেছে বিসিবির। সংস্থাটির আয়ের বড় উৎস আইসিসি-এসিসির লভ্যাংশ ভাগাভাগি। কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই বিপুল অঙ্কের টাকায় কোষাগার ফুলে-ফেঁপে ওঠার পরও ছেলেদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশ দলের বড় কোনো সাফল্য নেই।
মাঝেমধ্যে কিউরেটর গামিনি ডি সিলভার মাধ্যমে মিরপুরের উইকেটকে ব্যাটারদের 'বধ্যভূমি'তে পরিণত করে শক্তিশালী কয়েকটি দলের বিপক্ষে জয় পেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছে তারা।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফল যা-ই হোক, ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের অধীনে বিদেশি 'হাই প্রোফাইল' কোচ নিয়োগে বিশেষ মনোযোগ ছিল পাপনের। বিদেশি কোচ নিয়োগে কিছু পরিচালকের 'কমিশন-বাণিজ্য'র কথাও ভেসে বেড়ায় প্রায়শই।
পাপনের মেয়াদে সবচেয়ে বড় প্রকল্প ছিল পূর্বাচল স্টেডিয়াম। হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে নির্মাণ করতে যাওয়া এই উচ্চাভিলাষী প্রকল্প বাস্তবায়ন করার আগেই বিসিবি পরামর্শক ফি দিয়েছে ৭৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ রেখেছিল ২৫০ কোটি টাকা। অথচ শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় দেশ সেরা স্পোর্টিং উইকেটের ভেন্যু বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম ব্রাত্য থেকেছে বছরের পর বছর।
টেলিভিশন সম্প্রচার কিংবা গ্রাউন্স বিজ্ঞাপন রাইটসের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোও যেতো তার নিজের পছন্দের লোকদের পক্ষে। এতে করে দর্শকদের পক্ষ থেকে সম্প্রচার নিয়ে সব সময়ই অভিযোগ লেগেই থাকতো একই সঙ্গে বোর্ড কাঙ্ক্ষিত ব্যবসা করতে ব্যর্থ হতো। এই পুরো সময়ে জাতীয় দলের স্পন্সরশিপ অর্থও ক্রমান্বয়ে কমেছেই। এইসব অভিযোগ মাথায় নিয়েই হাসিনা সরকারের পতনের পর পতন ঘটলো বিসিবিতে পাপনের সাম্রাজ্যের।