ব্যক্তিগত পরিসর ছেড়ে রাষ্ট্রের মঞ্চে—‘পুতুল’ থেকে ‘আপসহীন নেত্রী’

বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমনন্ত্রী খালেদা জিয়া
বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমনন্ত্রী খালেদা জিয়া | ছবি : সংগৃহীত
0

বাংলাদেশের রাজনীতির এক অধ্যায়ের অবসান ঘটলো। ‘মা, মাটি ও মানুষের নেত্রী’ হিসেবে পরিচিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আজ (মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর) ভোর ৬টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। তার প্রয়াণের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতিতে এক প্রভাবশালী নারীনেত্রীর দীর্ঘ পথচলার ইতি হলো।

খালেদা জিয়ার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন। ভোর ৭টার দিকে বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস উইং কর্মকর্তা শামসুদ্দিন দিদার জানান, জানাজার সময়সূচি পরবর্তীতে জানানো হবে।

আরও পড়ুন:

বিএনপির দলীয়সূত্র ও জীবনীগ্রন্থ থেকে জানা যায়, খালেদা জিয়ার পারিবারিক নাম খালেদা খানম। তার ডাকনাম ছিল পুতুল। পরিবারের সদস্যদের কাছে তিনি টিপসি ও শান্তি নামেও পরিচিত ছিলেন। ‘নন্দিত নেত্রী: খালেদা জিয়া’ শীর্ষক গ্রন্থে তার উপ-প্রেস সচিব সৈয়দ আবদাল আহমেদ উল্লেখ করেন, ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুঁড়ির নয়াবস্তি এলাকায় তার জন্ম।

খালেদা জিয়ার বাবা ইস্কান্দার মজুমদারের বাড়ি ফেনীর ফুলগাজীতে হলেও তিনি জলপাইগুঁড়িতে বোনের বাসা থেকে পড়ালেখা করেন। পরে সেখানে চা ব্যবসায় জড়ান ইস্কান্দার; বিয়েও করেন।

বাবা ইস্কান্দর মজুমদার ও মা বেগম তৈয়বা মজুমদারের সন্তানদের মধ্যে তিনি তৃতীয়। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের পরিবারে বেড়ে ওঠা এই ‘পুতুল’ই পরবর্তী সময়ে দেশের রাজনীতির অন্যতম দৃঢ়চেতা নেত্রী হিসেবে পরিচিত হন।

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর খালেদা জিয়ার পরিবার বাংলাদেশের দিনাজপুর শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। সেখানে মিশনারি স্কুলে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরানোর পর দিনাজপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন খালেদা।

১৯৬০ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে খালেদার বিয়ে হয়। পরে স্বামীর কর্মস্থল পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। স্বাধীনতার পর ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপি গঠন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।

আরও পড়ুন:

স্বামী জিয়াউর রহমানের স্ত্রী হিসেবেই জীবনের বড় সময় কাটিয়েছেন খালেদা জিয়া। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পরই রাজনীতিতে সক্রিয় হন তিনি। ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপিতে যোগ দেন। এক বছরের মধ্যেই দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন এবং ১৯৮৪ সালের ১০ মে বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

দলের নেতৃত্বে এসে তিনি একাধিক রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা করেন। বিচারপতি সাত্তার অসুস্থ হলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী সময়ে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাবন্দিও হন।

নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ‘আপসহীন নেত্রী’ হয়ে ওঠা খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের বড় সময় কেটেছে রাজপথের আন্দোলনে। তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন, জেল খেটেছেন; তবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাননি।

আরও পড়ুন:

১৯৯১ সালে তার নেতৃত্বে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।

সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে কখনো হারেননি খালেদা জিয়া। তিনি ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে তিনবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।

২০০৮ সালের পর বিরোধীদলীয় নেতার ভূমিকা পালন করেন। ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় কারাবন্দি থাকা; এই সময়গুলোতে তিনি সক্রিয় রাজনীতির বাইরে থাকলেও দলের সিদ্ধান্তে প্রভাব রাখেন।

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে কারাবন্দি ও পরবর্তী সময়ে শর্তসাপেক্ষ মুক্তির পর তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। দীর্ঘদিন এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। লিভার সিরোসিসসহ একাধিক জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। ২০২০ সালে সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষ মুক্তি পান।

আরও পড়ুন:

গত বছরের আন্দোলনের পর রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাবলে তার দণ্ড মওকুফ হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য তিনি লন্ডন যান এবং কাতারের আমিরের দেওয়া এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে দেশে ফেরেন।

মৃত্যুকালে তার পাশে ছিলেন পরিবারের সদস্যরা, বিএনপির শীর্ষ নেতারা ও চিকিৎসকরা।

পরিবারের আদরের ‘পুতুল’ থেকে রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসা খালেদা জিয়ার এই পথচলা ছিল দ্বন্দ্ব, সংগ্রাম ও অনমনীয় অবস্থানের। সেই কারণেই সমর্থক ও অনুসারীদের কাছে তিনি থেকে গেলেন ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবেই।

আরও পড়ুন:

একনজরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া (১৯৪৫–২০২৫)

  • পুরো নাম: খালেদা খানম (পুতুল)।
  • জন্ম: ১৫ আগস্ট, ১৯৪৫; জলপাইগুড়ি, পশ্চিমবঙ্গ (পৈত্রিক নিবাস: ফেনী)।
  • পরিচয়: সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপির চেয়ারপারসন এবং স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের ‘আপসহীন নেত্রী’।
  • মৃত্যু: ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৫ (মঙ্গলবার); ভোর ৬টা, এভারকেয়ার হাসপাতাল, ঢাকা।
  • রাজনীতিতে অভিষেক: ৩ জানুয়ারি, ১৯৮২ (স্বামী জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর)।
  • দলীয় নেতৃত্ব: ১৯৮৪ সাল থেকে আমৃত্যু বিএনপির চেয়ারপারসন।
  • প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব: মোট তিনবার (১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সাল)।
  • সংসদীয় গণতন্ত্র: ১৯৯১ সালে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।
  • নির্বাচনি রেকর্ড: অংশ নেওয়া কোনো নির্বাচনেই (৫টি আসনে প্রার্থী হয়েও) কখনো পরাজিত হননি।
  • পিতা-মাতা: ইস্কান্দার মজুমদার ও বেগম তৈয়বা মজুমদার।
  • বিবাহ: ১৯৬০ সালে তৎকালীন ক্যাপ্টেন (পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট) জিয়াউর রহমানের সাথে।
  • সন্তান: দুই পুত্র—তারেক রহমান ও মরহুম আরাফাত রহমান কোকো।
  • শিক্ষা: দিনাজপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও সুরেন্দ্রনাথ কলেজ।
  • স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন: আশির দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে আপসহীন নেতৃত্ব।
  • কারাবরণ: ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী সময় এবং ২০১৮ সালে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় কারাবন্দি হন।
  • মুক্তি: ২০২০ সালে সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষ মুক্তি এবং ২০২৪ সালে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাবলে দণ্ড মওকুফ।
  • অসুস্থতা: লিভার সিরোসিসসহ বার্ধক্যজনিত একাধিক জটিলতায় দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন।
  • জীবনাবসান: ৮১ বছর বয়সে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

আরও পড়ুন:

এসএইচ