আটপৌড়ে জীবন থেকে রাজনীতির ময়দানে লড়াই সংগ্রামের সিড়ি মারিয়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহী পদে অধিষ্ঠিত হন খালেদা জিয়া। তিন বার দেশের সরকারকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এই নারী রাজনীতিবিদ। গণতন্ত্রকে সুসংহত করার লড়াই ও দুরদর্শী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ইস্যুতে ইতিহাসে সব সময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবেন।
খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে হাতেখড়ি মূলত তার স্বামী সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর। ১৯৮১ সালের ৩০ এপ্রিল বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে চট্টগ্রামে নিহত হন জিয়াউর রহমান। স্বামীর মৃত্যুর পর অভ্যন্তরীন কোন্দলে ও অনেক নেতা এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দিলে, দলের হাল ধরেন খালেদা জিয়া।
১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি গৃহবধু থেকে রাজনীতিতে আনুষ্ঠানিক পথচলা শুরু হয় বেগম জিয়ার। রাজনৈতিক বাস্তবতায় কিছুদিনের মধ্যেই হয়ে ওঠেন দলের নীতিনির্ধারক। ১৯৮৪ এর ১০ মে নির্বাচিত হন বিএনপির চেয়ারপারসন। হয়ে উঠেন জাতীয়তাবাদী ধারার মানুষের একক নেতা।
কারাবরণ ও দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পর ১৯৯১ সালে জাতীয় নির্বাচনে অভাবনীয় সাফল্যে পায় বিএনপি। রাজনীতিতে নামার মাত্র দশ বছরের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী হন বেগম জিয়া। দেশের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রীও তিনি। দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপাতি শাসিত সরকার থেকে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা চালু করেন খালেদা জিয়া। প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, অবকাঠামোগত উন্নয়নে প্রশংসা কুড়ান তিনি।
১৯৯৬ সালের ১৫ জানুয়ারী ষষ্ঠ জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। তবে অধিকাংশ দল বর্জন করে সেই ভোট। বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের মুখে দেড় মাস পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন তিনি। ১৯৯৬ সালের ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হেরে যায় বিএনপি। পরে আওয়ামী লীগ সরকারের পাঁচ বছরের আন্দোলন সংগ্রামের পর ২০০১ সালের নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে পুনরায় সরকার গঠন করে বিএনপি।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের মেয়াদ শেষে ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুর্নীতির মামলায় গ্রেফতার হন তিনি। দীর্ঘ এক বছর কারাবাসের পর মুক্তি পেয়ে ফের রাজনীতিতে সক্রিয় হন তিনি।
২০০৮ সালের নির্বাচনে হেরে বিরোধী দলীয় নেতা হন খালেদা জিয়া। ২০১৪ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে জাতীয় নির্বাচন বয়কট করে বিএনপি। যদিও সে দফায় সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। ১৯৯১ সালের পর এই প্রথম সংসদের বাইরে থেকে রাজনীতি করেন খালেদা জিয়া।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়ের করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পাঁচ বছর কারাদণ্ড হয় তার। ঐদিনই তাকে নেয়া হয় নাজিমউদ্দিন রোডের পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারে। একই বছর অক্টোবরে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলাতেও ৭ বছরের সাজা পান তিনি।
দণ্ডিত হওয়ায় ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে অযোগ্য হন তিনি। তবে তাকে ছাড়াই নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। এরপর থেকে খালেদা জিয়াকে আর রাজনীতির মাঠে স্বরুপে দেখা যায়নি।
কারাগারে থাকা অবস্থায় দেশে করোনা সংক্রমণ বেড়ে গেলে খালেদা জিয়াকে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পান খালেদা জিয়া। এর মধ্য দিয়ে প্রায় ২৫ মাস কারাবাসের পর গুলশানে নিজ বাসায় ফেরেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
শারীরিক অসুস্থতা বিবেচনায় পরবর্তীতে মুক্তির মেয়াদ আরো কয়েক দফায় বাড়ানো হয়। ২০২১ সালের ১১ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হলে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয় খালেদা জিয়াকে। এরপর থেকেই শারীরিকভাবে ভেঙে পড়তে থাকেন বেগম জিয়া।
২৪ এর ৫ আগস্টে ছাত্র জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে ৬ আগস্ট খালেদা জিয়ার সাজা বাতিল করে দেন রাষ্ট্রপতি।
তবে আইনিভাবে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে উচ্চ আদালতে আপিল করেন তার আইনজীবীরা। হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ দুটি দুর্নীতির মামলার সাজা বাতিল করে রায় দেন। এর মধ্যদিয়ে খালেদা জিয়া দুর্নীতির অভিযোগ থেকে মুক্ত হন।
চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্য যান খালেদা জিয়া। ছয় মাস পর চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে আসেন বিএনপি চেয়ারপারসন। এরপর কয়েকটি জনসভায় তাকে ভার্চুয়ালি বক্তব্য দিতে দেখা গেছে। সবশেষ ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনীর দিবসের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন খালেদা জিয়া।
তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জন্ম ১৯৪৫ সালে, করাচিতে। জীবনে কোনো নির্বাচনে হার না মানা খালেদা জিয়া টানা ৩৫ বছর দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপিকে সফলতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছেন।





