বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি হলো: মির্জা ফখরুল

বক্তব্য রাখছেন মির্জা ফখরুল
বক্তব্য রাখছেন মির্জা ফখরুল | ছবি: এখন টিভি
0

বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি হলো বলে মন্তব্য করেছে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি হলো। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর গণতান্ত্রিক আন্দোলনে একটা বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি হলো।’ আজ (মঙ্গলবার, ৩০ ‍ডিসেম্বর) সকাল ৯টার দিকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির পক্ষ থেকে প্রেস ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেন তিনি।

মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘এই সংবাদিটি নিয়ে আপনাদের সামনে দাঁড়াতে হবে, এটা কখনও ভাবিনি। আমরা আবারও আশা করছিলাম তিনি আগের মতোই সুস্থ হয়ে উঠবেন। আজ ভোর ৬টায় আমাদের গণতন্ত্রের মা, আমাদের অভিভাবক, আমাদের জাতীয় অভিভাবক আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। এই শোক, এই ক্ষতি অপূরণীয়, যা এই জাতি কখনও পূরণ করতে পারবে না।’

বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘যে নেত্রী তার সারাটা জীবন জনগণের জন্য, কল্যাণের জন্য তার সমগ্র জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন, সেই নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আমাদের মাঝে নেই। আমরা যারা তার রাজনৈতিক কর্মী এবং সহকর্মী, আমরা এটা ভাবতেও পারি না।’

সাংবাদিকদের উদ্দেশে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এই কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস আমাদের ফোন করেছিলেন সঙ্গে সঙ্গে। এরইমধ্যে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সকাল দশটা-সাড়ে দশটার মধ্যেই তারা স্পেশাল ক্যাবিনেট মিটিং করবেন। সেই ক্যাবিনেট মিটিংয়ে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার যে শেষ কাজগুলো, তার জানাজা, তার দাফন, তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা, তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়া- এই বিষয়গুলো নিয়ে তারা দশটা-সাড়ে দশটায় একটা সভা করবেন। এরপর আমরা পুরো জিনিসটাকে কো-অর্ডিনেট করে সেটা আপনাদের আবার জানাবো।’

আজ মঙ্গলবার ভোর ৬টায় ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যু হয়। তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।

শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় ২৩ নভেম্বর জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল খালেদা জিয়াকে। এর আগে ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে রওনা দিয়ে গাড়িতে ওঠেই অস্বস্তি বোধ করছিলেন তিনি। বহু বছর ধরেই তিনি লিভার সিরোসিস, আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, ফুসফুস এবং চোখের সমস্যাসহ নানা জটিলতায় ভুগছেন।

ঢাকায় নিজের বাসায় থাকা অবস্থাতেই ২০২১ সালের মে মাসে করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নেন তিনি। তখনও শ্বাসকষ্টে ভোগার কারণে তাকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে থেকে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল। এরপর ২০২৪ সালের জুনে তার হৃদপিণ্ডে পেসমেকার বসানো হয়। তখনও তিনি মূলত হার্ট, কিডনি ও লিভারসহ বিভিন্ন ধরনের রোগে ভুগছিলেন, যা তার শারীরিক অবস্থাকে জটিল করে তুলেছিল।

এর আগে থেকেই তার হার্টে তিনটি ব্লক ছিল। আগে একটা রিংও পরানো হয়েছিল। এছাড়া ২০২৪ সালের জুনে পোর্টো সিস্টেমেটিক অ্যানেসটোমেসির মাধ্যমে খালেদা জিয়ার লিভারের চিকিৎসাও দেয়া হয়েছে বিদেশ থেকে ডাক্তার এনে।

আওয়ামী লীগ আমলে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন আদালত, তারপর থেকে প্রথমে কারাগারে বিশেষ ব্যবস্থায় ও পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। দুর্নীতির আরেকটি মামলাতেও তাকে কারাদণ্ড দেয়া হয়। পরে হাসপাতালে থাকা অবস্থাতেই নির্বাহী আদেশে বিশেষ শর্তে মুক্তির পর তিনি গুলশানের বাসায় উঠেন। ২০২৪ সালে আগস্টে গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতির নির্বাহী আদেশে তাকে সব দণ্ড থেকে পুরোপুরি মুক্তি দেয়া হয়।

১৯৪৫ সালে জলপাইগুড়িতে জন্ম নেয়া খালেদা জিয়া দিনাজপুর মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা করেন। ১৯৬০ সালে দিনাজপুর গার্লস স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। খালেদা জিয়ার বাবা ইস্কান্দার মজুমদার ছিলেন ব্যবসায়ী। মা তায়েবা মজুমদার ছিলেন গৃহিণী। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন তিনি। তার ডাকনাম ছিল ‘পুতুল’।

১৯৬০ সালে তিনি তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানকে বিয়ে করেন এবং ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত দিনাজপুরের সুরেন্দ্রনাথ কলেজে পড়াশোনা করেন। এরপর তিনি স্বামীর সঙ্গে থাকার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহ করে যুদ্ধে অংশ নেন। সে সময় খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানি বাহিনী। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয়ের পর তিনি মুক্তি পান।

১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমানকে হত্যার পর তীব্র নেতৃত্ব সংকটে পড়ে বিএনপি। ঠিক সেই সময় কখনও রাজনীতিতে না আসা খালেদা জিয়া দলটিতে যোগ দেন এবং ১৯৮৪ সালের ১২ জানুয়ারি সহসভাপতি হন। একই বছরের ১০ মে তিনি দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে তিনি পুনরায় চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১৯৮৩ সালে সাতদলীয় জোট গঠন করে এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। এরশাদ সরকার তার চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দেয় এবং বহুবার আটক করে। তবু খালেদা জিয়া এরশাদবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে যান, হয়ে ওঠেন ‘আপসহীন নেত্রী’।

এসএইচ