রক্তে অর্জিত বাংলা ভাষায় আধিপত্য ইংরেজির!

বিশেষ প্রতিবেদন , শিল্পাঙ্গন
দেশে এখন
0

একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু বাংলাভাষীদের জন্য নয় এটি সকল ভাষাভাষীদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানানো দিন। ১৯৫২ সালে বুকের তাজা রক্তে অর্জিত বাংলা ভাষা আজ বিদেশি ভাষার দখলে। শহরের স্কুল-কলেজ থেকে বিপণিবিতান, সর্বত্র ইংরেজির আধিপত্য। ভাষা পরিবর্তনশীল, তবে অতিরিক্ত নির্ভরতা বাংলাকে দুর্বল করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারি উদ্যোগে বাংলার ব্যবহার বাড়ানো জরুরি।

১৯৫২ সালে ছাত্রদের নাম ধরে ধরে জেলখানায় ঢোকানোর সময় ডেপুটি জেলার সাহেব হাঁপিয়ে ওঠেন। এবং বিরিক্তর সঙ্গে বলেন, 'উঁহুঁ, এত ছেলেকে জায়গা দেব কোথায়। জেলখানা তো এমনিতে ভর্তি হয়ে আসছে।' প্রত্যুত্তরে পাশ থেকে ছাত্রদের মধ্য থেকে একজন চিৎকার করে বলেন, 'এতেই ঘাবড়ে গেলেন নাকি? আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো।'

জহির রায়হানের আরেক ফাল্গুন উপন্যাসে এই উক্তি যেন পুনর্জীবিত হয়েছিল '২৪-এর জুলাইয়ে, '৫২-এর মতো '২৪ এও মাথা নোয়ায়নি তরুণরা।

বায়ান্নয়, যে ভাষার জন্য এত আত্মত্যাগ সে ভাষার দখল নিচ্ছে বিদেশি ভাষা। এই শহর যেন তারই স্পষ্ট প্রমাণ। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, বিপণিবিতান, হাসপাতাল এমনকি ছোটখাটো দোকানের নামও ইংরেজিতে দেয়া।

ব্যানার, বিলবোর্ড এবং বিজ্ঞাপনচিত্রেও দেখা যায় বাংলা ভাষার সাথে ইংরেজির এক অদ্ভুত মিশ্রণ।

সন্তানদের পড়াশোনায় ইংরেজি মাধ্যমকেই বেছে নিচ্ছেন অনেক অভিভাবক। যার কারণে, অনেক শিশুরই বাংলাটা ঠিক আসে না।

একজন শিশু বলেন, 'শব্দার্থ করতে হয়। ম্যাথ প্রতিদিন হয় আমাদের। টু আওয়ার্স ফর মাই টিচার্স অ্যান্ড ওয়ান আওয়ার ফর মাই হোমওয়ার্ক।'

বাংলা বাক্যের ভেতরে অহরহ ব্যবহার হচ্ছে ইংরেজি শব্দ। আর 'বাংলিশ' নামের এমন বিকৃতি নিয়েও গর্বের শেষ নেই কারও কারও।

তাই এখন প্রশ্ন জাগে, রক্তের দামে লেখা ভাষা কি আমরা ভুলতে বসছি? ভুলতে বসেছি সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের প্রত্যাশা?

আলোকচিত্রী শহিদুল আলম বলেন, 'যে মানুষগুলোর সংগ্রামের কারণে আজকে আমি, আপনি, আমরা নিজের ভাষায় কথা বলতে পারছি। সেটাকে তো আমরা ভুলে গেছি। আজকে আবু সাঈদ, মুগ্ধর ব্যাপারে আজকে হয়তো মনে আছে। ৫০ বছর পরে আমরা মনে রাখবো কি না, আমি জানি না। আরেক দেশকে বা আরেক দেশকে, আরেক ভাষাকে আমি উপরের স্তরে মনে করি, তখন তো আমি দাসত্বে চলে গেছি। এবং এই দাসত্ব থেকে যদি আমরা না বেরোতে পারি তাহলে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন হলাম কী করে?'

আরো পড়ুন: গণঅভ্যুত্থানের আবহে পালিত হচ্ছে শহীদ দিবস

ভাষা সর্বদা পরিবর্তনশীল। বিভিন্ন ভাষার সংমিশ্রণে নতুন নতুন শব্দ গঠিত হয়, যা ভাষার বিবর্তনের স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু অন্য ভাষার ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা ভাষাকে করে তুলে দুর্বল। তাই সরকারিভাবে বাংলার ব্যবহারে জোর দেয়ার তাগিদ দেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম বলেন, 'ভাষার সবচেয়ে অভিজাত ব্যবহার ঘটে তিন জায়গায়। একটা হচ্ছে সরকারি অফিস, আদালতে। আর একটা হলো আইন বিভাগে, আর এগুলোর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো উচ্চশিক্ষায়। এই যে সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে বাংলার ব্যবহারটা নিশ্চিত হয়নি, উচ্চশিক্ষায় ব্যবহারের মধ্য দিয়ে বাংলার গভীরতা এবং প্রসারতা বাড়েনি। এটাই আসলে সমাজে বাংলার প্রতি মানুষের যে দৃষ্টিভঙ্গি, তার উৎস।'

ভাষাবিদরা সতর্ক করছেন, বাংলা যদি তার নিজস্বতা হারায়, তাহলে ভবিষ্যতে এটি শুধু আনুষ্ঠানিক ভাষায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে, আর দৈনন্দিন ব্যবহারে অন্য ভাষা এসে জায়গা নেবে।

এসএস