দেশে এখন
0

প্রাণ হারানো একেকটি পরিবারের ক্ষতি পূরণ হবে কীভাবে?

গণঅভ্যুত্থানে যারা গুলির কাছে মাথা নত করেনি। মুক্তির জন্য যারা করেছেন সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ, সেই পরিবারগুলো ভালো নেই। ঘাতকের গুলি কেবল একজন মানুষকে ভেদ করে গেছে কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত করেছে পুরো পরিবারকে। আর শুধু আন্দোলনকারী নন, এলোপাথাড়ি গুলিতে অনেকেই হারিয়েছেন তার একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে। কেউ হারিয়েছেন সাজানো সংসার।

ঘাতকের ট্রিগার থেকে মুহুমুর্হু ছুটছে যে বুলেট, তার গন্তব্য কোথায়? বুক এফোঁড় ওফোঁড় করা সে বুলেট বিদীর্ণ করেছে জুয়েলের রক্তমাংসের শরীরকে। শুধু যে জুয়েলই চিরদিনের জন্য নাই হয়ে গেলো তা নয়, নিঃসীম অন্ধকারে আলোহীন পথিকের মত দিগ্বিদিক এখন পুরো পরিবার।

কী খাবে, কোথায় থাকবে এমন নির্মম শোকে কাঠ হয়ে যাওয়া পরিবারের ৯ সদস্যের কারও জানা নেই। জুয়েল চলে যাবার পর তাদের বিদীর্ণ বুকে সম্বল শুধু চোখের পানিটুকুই।

শত্রুপক্ষ, পাকিস্তানি বাহিনী, মুক্তিযুদ্ধ এ প্রজন্ম বইয়ের পাতায় জেনেছে অনেক কিছুই। কিন্তু এ কোন যুদ্ধ, স্বাধীন দেশে যারা নিরীহ মানুষের বুকে গুলি চালায়। পাঁচ বছরের সংসার ছিল জুয়েল আর সুমাইয়ার। সুমাইয়া বলছেন, অবুঝ শিশুটি এখনও জানেন না তার বাবাটি আর নেই।

সুমাইয়া বলেন, 'আমি বাইরে দাঁড়াইছি, তখন আমাকে বলছে তোমাকে একটা কথা বলি তুমি রাখবা। আর তারপরই আমি বুঝে গিয়ে বলছি যে, তুমি আন্দোলনে যাবা? আমি বললাম, তুমি আমার কথা চিন্তা না করো, আমাদের দুইটা সন্তান আছে তাদের কথা চিন্তা করো। কিন্তু আমার কথা শুনেনি। বলছে, না আমি যামুই। যদি আমার কিছু হয়ে যায় মনে করবা যে তোমার স্বামী শহীদ হয়ে গেছে।'

তারিখটি ছিল ৪ আগস্ট। পুরো শহর পরিণত হয়েছিল রণক্ষেত্র। ছাত্র-জনতা স্বৈরাচারের পতনের দাবিতে রাজপথে উত্তাল। রাজপথের দাবি উপেক্ষা করতে পারেন নি জুয়েলের পুরো পরিবার। কিন্তু দুই ভাই বোন ফিরলেও আর ফেরা হয় নি জুয়েলের।

জুয়েলের বোন বলেন, 'তিন ভাইবোন বলি আজ একসাথে আন্দোলনে যাবো। মা বলে, আমি আমার সন্তান হারিয়ে ফেললে কী করবো? পরে বলা হইলো, আজকে ঝামেলা নেই, আর ঝামেলা হইলেও সমস্যা নেই, রাস্তায় ছাত্র আছে অনেক। আমার ছোট ভাইয়ের বন্ধু ফোন দিয়ে বলে আপু বাসায় আসো। বাসায় অ্যাম্বুলেন্স আসছে জুয়েল ভাইয়াকে নিয়ে।'

পুলিশের মুহুর মুহুর গুলিতে ২০ জুলাই সারাদেশ থেকে আসে ছাত্র নিহত হওয়ার খবর। তবে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত নন এমন অনেকেই নিহত হয়েছে এ সময়ে।

মোবাইল ম্যাকানিক সোহেল নিজ বাসার সামনেই ২০ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়। তার স্ত্রী আয়েশা হারান মাথার উপর থাকা একমাত্র বটবৃক্ষ।

আয়েশা বলেন, 'বিনা অপরাধে তাকে গুলি করা হয়েছে। আমি বুঝতে পারছিলাম যে, তার রক্ত বের হচ্ছে, আমি অনেক চেষ্টা করছি তার রক্ত বন্ধ করার জন্য। আমার হাতে অনেক তুলা ছিল, কোনোভাবেই রক্ত বন্ধ করতে পারিনি।'

হারিয়েছেন সাজানো সংসার। চার বছরের ছেলেকে নিয়ে কোথায় যাবেন? কি করবেন আয়েশা? সেটি এখনও বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি।

আয়েশা বলেন, 'এখন আমার তো ভবিষ্যৎ বলতে কিছু নেই। আমি এখন বাবা-মার বাড়িতে আছি, আমার একটা ভাই আছে। আমার ছেলে চার বছর বয়স। আমাদের সংসারে একমত সেই কর্মক্ষম ছিল। আমার মাথার ওপর একটা বটগাছ ছিল, সেটা ঝড়ে গেছে। আমার শাশুড়ি আজ আসছিল, সে পাগলপ্রায়। সারাদিনই কান্নাকাটি করে।'

শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে ফিরে যেতে হয় রুদ্র মোহাম্মদ শহিদুল্লাহর কাছে। যেখানে রাইফেল তাক করা সৈনিককে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, তোমার বুলেট মানুষের বুক লক্ষ্য করে ছুটে যাচ্ছে। যে মানুষের মধ্যে কেউ একজন তোমার ভাই, কেউ একজন তোমার পিতা, কেউ একজন তোমার বোন, তোমার ছেলে, সেই মানুষের দিকে তোমরা টার্গেট প্র্যাক্টিস করছো?

ঢাকা মেডিকেল দেয়নি শহীদ জুয়েলের ডেড সার্টিফিকেট। জুয়েলের মত অনেককেই দেয়া হয়নি ডেড সার্টিফিকেট।

জুয়েলের ভাই বলেন, 'আমরা কেউ চাইনি আমার ভাই এভাবে অকালে মারা ডাবে। আমার ভাইয়ের মৃত্যুর সাথে যারা জড়িত আছে, আমরা চাই তাদের বিচার হোক। এবং আমার ভাইয়ের ডেড সার্টিফিকেটটাও দরকার।'

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামান বলেন, 'আমরা যদি প্রত্যেকের পোস্ট-মোর্টেম করে দিতাম তাহলে এই হয়রানিটা হতো না। সেটা যেহেতু আমরা বিভিন্ন কারণে করতে পারিনি। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আছে এই বিষয়টি। স্বাস্থ্য উপদেষ্টা আমাদের হাসপাতালে এসেছিলেন তাকে আমরা জানিয়েছি। ততদিন পর্যন্ত আমার মনে হয় সবাই একটু ধৈর্য ধরুক। অকারণে আমাদের ওপর চাপাচাপি করলেই কিন্তু এটা আমরা পারবো না।'

শত শত পরিবারের আত্মত্যাগে দেশ মুক্ত হয়েছে স্বৈরাচার শাসনের হাত থেকে। তাদের রক্তের ঋণ এ জাতি মনে রাখবে অনন্তকাল। এমনটাই বলছেন নতুন প্রজন্ম।

tech