চট্টগ্রামের ফিশারিঘাট এলাকায় গেলে দেখা মিলবে সাদা বক্সের ছোটখাট পর্বত। দেশের দূর দূরান্তের জেলায় মাছ পরিবহনের প্রধান মাধ্যম কর্কশিটের এসব বক্স। যেখানে বরফ দিয়ে দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করা যায় । তাই মৎস্য বাণিজ্যের সাথে তাল রেখে দিন দিন বেড়েছে এর চাহিদা। ১০ বছর আগেই যেখানে দিনে মাত্র ৪০০ থেকে ৫০০টি বক্সের ব্যবহার ছিল, এখন তা ঠেকেছে তিন থেকে চার হাজারে।
সোনালী যান্ত্রিক মৎস্যশিল্প সমবায় সমিতির পরিচালক মো.কাউসার উজ জামান বলেন, 'চট্টগ্রামে বিভিন্ন জেলা থেকে যেসব মাছ আসে, সব এখন কর্কশিটের বক্সে আসছে। এছাড়াও ভারক ও বার্মা থেকে সেব মাছ বাসছে সেগুলোও কর্কশিটের মধ্যেই আসছে।'
নগরের চেরাগির মোড়েই চোখে পড়ে ভ্যানগাড়ি ভর্তি কর্কশিট আনার দৃশ্য। এখানকার ফুলের দোকান ঘিরে গড়ে উঠেছে এই পণ্যের রমরমা ব্যবসা। বিয়ে-শাদি, জন্মদিন, পূজা-পার্বণ বা শ্রদ্ধা নিবেদন সবকিছুতেই লাগছে কর্কশিট। এখানে আধা কিলোমিটার এলাকায় গড়ে উঠেছে কর্কশিটের একধরনের খুচরা ও পাইকারি বাজার। গত এক দশকে এই বাজার বেশ বিস্তৃতি লাভ করেছে।
চারুশিল্পী ও ইভেন্ট আয়োজক দীপক দত্ত বলেন, 'ধীরে ধীরে কর্কশিটের প্রয়োজন বেশি হয়, সেজন্য চাহিদা বাড়ে। এতে অনেক কারখানাও গড়ে ওঠে। এখন তো যেকোনো সাইজের কর্কশিট পাওয়া যায়।'
ওয়ানটাইম প্লেট থেকে শুরু করে নির্মাণ শিল্প বা এভিয়েশন খাত, কৃষি, ওষুধ হয়ে ইলেকট্রনিক্সের বিশাল বাজার। বিশ্বব্যাপী ই-কমার্স ও বাণিজ্যের আন্তর্জাতিক পরিসর বাড়ায় প্যাকেজিংয়ের সাথে তাল রেখে বেড়েছে এর চাহিদা। নানা শিল্পে এই পণ্য হয়ে উঠেছে অপরিহার্য।
যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণা বলছে, বিশ্বব্যাপী কর্কশিটের বাজার সবচেয়ে বেশি বাড়ছে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে। চীন ও ভারতে এর চাহিদা ছাড়িয়েছে আগের সব রেকর্ড। বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ১৬৫ বিলিয়ন কর্কশিটের প্যাকেজ ব্যবহৃত হয়। যার বাজারমূল্য ১৪.৯৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা প্রতি বছর ৬ শতাংশ হারে বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের এলেন ম্যাকআর্থার ফাউন্ডেশনের একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, শুধু নিউইয়র্ক শহরেই প্রতি বছর ১৪ মিলিয়ন টনেরও বেশি কর্কশিট বর্জ্য উৎপন্ন হয়।
বিশ্বব্যাপী এর পরিচিত থার্মোকল বা স্টাইরোফোম হিসেবে। যা ১০০ বছরেরও বেশি সময় টিকে থাকতে পারে পরিবেশে।
মাছ সংরক্ষণ থেকে ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর সুরক্ষা, বিয়ে সাদির ইভেন্ট হোক বা ঘরসজ্জা, গত এক দশকে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে কর্কশিটের ব্যবহার। বিস্তৃত হয়েছে এর বাজার। এই পণ্য বা বহুমুখী ব্যবহারের বস্তুটি অল্প দিনে ফেলনা হয়ে গেলেও এটির পরিবেশগত হুমকি পলিথিন বা প্লাস্টিকের মতো খুব একটা বিবেচনায় নেই। বিশেষ করে জলাবদ্ধতার উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা চট্টগ্রামের মতো শহরের নালা নর্দমায় আবর্জনা জটের পেছনে এই কঠিন বর্জ্যের ব্যাপক ভূমিকা থাকলেও এটি রোধে বিভিন্ন সেবা সংস্থার রয়েছে পরিকল্পনা ও প্রকল্পের অভাব।
চট্টগ্রামে যে কোনো নালা খাল দেখে মনে হবে যেন কর্কশিট বর্জ্যের ভাগাড়। এই এলাকাকে ঘিরে গড়ে ওঠা টাইলস স্যানিটারির দোকান ও বিভিন্ন পণ্য পরিবহন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিনিয়ত ফেলা হয় কর্কশিট।
স্থানীয় একজন বলেন, 'এই কর্কশিটগুলো আমরা বিদেশ থেকে প্লেনে করে এসে ফেলছি না, এগুলো বিভিন্ন প্যাকেজিং কোম্পানি এনে ফেলেছে। তারা আবর্জনা তৈরি করছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার।'
ইসপা প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের মুখপাত্র আবদুস সবুর বলেন, 'প্লাস্টিক বা পলিথিনের হয়তো রিসাইকেল শুরু হয়েছে। বিন্তু এই থার্মোতল বা কর্কশিটের কোনো রিসাইকেল হচ্ছে না। এটি ব্যবহারের পর কোথঅয় ফেলা হচ্ছে সে বিষয়েও কেও খোঁজ খবর রাখছে না। এটার রিসাইকেল ভ্যালুচেইনটা এখনও চট্টগ্রামে দাঁড়ায়নি বা এর তোনো রিসাইকেল ভ্যালু নেই।'
কর্কশিট বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় এতদিন পরিকল্পনার ঘাটতি থাকলেও বিষয়টিকে বেশ গুরুত্বের সাথে দেখছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। অগোচরে থাকা এমন হুমকিকে মোকাবেলায় প্রকল্প গ্রহণের কথা জানালেন কর্মকর্তারা।
চসিকের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. মোবারক আলী বলেন, 'যারা বিনিয়োগকারী এর উৎপাদন থেকে তাদের সড়ে দাঁড়াতে হবে। যারা পলি নিয়ে কাজ তরছে আমরা তাদের উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছি।'
পশ্চিমের বহু দেশ এর মধ্যে কর্কশিটের মূল উপাদানে বায়ো ডিগ্রেডেবল বা পচনশীল প্রযুক্তির উদ্ভাবন করেছে। কর্কশিট যত্রতত্র ব্যবহার রোধে পাশের দেশ ভারতে নেয়া হয়েছে নানা বিধিমালা।