সুন্দরবনের কোল ঘেঁষেই অবস্থান খুলনার কয়রা উপজেলার। কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদী ঘিরে রেখেছে এ উপকূলের জনপদকে। এই এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেশের অন্যান্য উপজেলা থেকে বেশ আলাদা এবং মনমুগ্ধকর। তবে এখানকার নদী গুলো মানুষের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস হলেও ভাসিয়ে নিয়েছে হাজারো মানুষের বসতি, কেড়ে নিয়েছে জীবন-জীবিকা।
দীর্ঘদিন ধরেই কয়রা উপজেলার মানুষের জীবন কাটছে ঝড়ঝাপ্টার সাথে যুদ্ধ করে। সিডর, আইলা, আম্পানসহ নানান দুর্যোগের ক্ষত আজও রয়ে গেছে এসব এলাকায়। জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার জন্য এ উপজেলায় রয়েছে প্রায় ১৫৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। প্রাকৃতিক দুর্যোগের আভাস আসলেই এই দুর্বল বেড়িবাঁধই হয়ে ওঠে এ এলাকার মানুষের ভয়ের কারণ। প্রতিবারই ঝড় বা জলোচ্ছ্বাস বাঁধ ভেঙ্গে পানি ঢুকে পড়ে লোকালয়ে। তলিয়ে যায় বসতি ও ফসলের ক্ষেত বা মাছের ঘের।
এলাকাবাসীদের একজন বলেন, 'কোনো জায়গায় মাটি আছে কোনো জায়গায় নেই। বাঁধ ভেঙ্গে গেলে আমরা একদম নিরুপায়।'
আরেকজন বলেন, 'যদি বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যায় তাহলে পুরো এলাকা তলিয়ে যাবে।'
উপজেলায় ১০টি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। কয়রা উপজেলার সদরের মদিনাবাদ লঞ্চঘাট থেকে গোবরা পর্যন্ত প্রায় ১ কিলোমিটার, হরিণখোলা-ঘাটাখালি এলাকায় ১ কিলোমিটার, ৬ নম্বর কয়রা এলাকায় ৬০০ মিটার, ২ নম্বর কয়রা এলাকায় ৫০০ মিটারসহ মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের শেখেরকোনা, নয়ানি, শাপলা স্কুল, তেঁতুলতলার চর ও চৌকুনি এলাকায় ৩ কিলোমিটারের মতো বাঁধ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষের দিকে ৩২ কিলোমিটার স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণে একটি মেগা প্রকল্প শুরু করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। সেখানে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪'শ ৭২ কোটি টাকা। তবে বিভিন্ন স্থানে সংস্কারের কাজ চলছে বলে জানায় পানি উন্নয়ন বোর্ড।
খুলনা-২ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আশরাফুল আলম বলেন, 'প্রায় ৬৩০ কিলোমিটারের মতো বেঁড়িবাধ রয়েছে। ইতিমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে।'
জলোচ্ছ্বাসের ভয় ছাড়াও এ অঞ্চলের মানুষের একটি বড় সমস্যা সুপেয় পানির সংকট। এখানে পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেশি হওয়ায় বেশিরভাগ মানুষকেই কিনতে হয় পানি। নলকূপে সুপেয় পানি আসলেই তা বিক্রি করা হয় পুরো গ্রামে। আবার কেউ কেউ খাওয়ার জন্য জমিয়ে রাখেন বৃষ্টির পানি।
স্থানীয়দের একজন বলেন, 'যেই নলকূপ রয়েছে এইগুলার পানি খাওয়া যায় না। পানি লবণাক্ত। আমরা ট্যাংকিতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখে সেখান থেকে সংগ্রহ করি।'
উপকূলবর্তী এই জনপদের মানুষের প্রধান আয়ের উৎস নদী থেকে মাছ শিকার ও কৃষিকাজ। অবকাঠামোগত কিছু উন্নয়ন হলেও এখানকার মানুষের আয় থেমে সেই একই জায়গায়। আর্থসামাজিক উন্নয়ন না হওয়ায় এ এলাকা ছাড়ছেন হাজারো মানুষ। ঢাকা, খুলনা বা চট্টগ্রামের মতো শহরে গিয়ে করছেন দিন মজুরের কাজ।
কয়রা উপজেলার মানুষের মান উন্নয়নে উপজেলা প্রশাসন থেকে নেয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ। কৃষি কাজ থেকে শুরু করে মাছ চাষে তাদের দেওয়া হচ্ছে প্রশিক্ষণ।
কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিএম তারিক উজ জামান বলেন, 'জলবায়ু সহিষ্ণু ফসল পরিক্ষামূলক চাষ করে আমরা সফল। আমরা দেখেছি যে বিগত সময়ের থেকে এখন কৃষির উৎপাদন বেড়ে গিয়েছে।'
এদিকে উপজেলার মানুষের একমাত্র চাওয়া টেকসই বেড়িবাঁধ। তার জন্য কাজ চলমান রয়েছে বলে জানান স্থানীয় সংসদ সদস্য। উপজেলার নানা সমস্যা সমাধানে কাজ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
খুলনা-৬ সংসদ সদস্য মো. রশীদুজ্জামান বলেন, 'পানি ট্যাংকিতে সংগ্রহ ছাড়া এর বিকল্প নেই। এই কারণে জরুরিভাবে ট্যাংকি প্রত্যেক ঘরে ঘরে পৌঁছায় সেই পরিমাণ চাহিদা দিয়েছে।'
খুলনার কয়রা উপজেলায় প্রায় ৩ লাখ মানুষের বসবাস। টেকসই বেড়িবাঁধসহ নিজেদের জীবন মান উন্নয়ন করতে চাই স্থানীয়রা।