বিকেল চারটার কিছু পরে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আজ আমরা বাংলাদেশের জনতা, যারা জুলুমের ইতিহাস জানি, প্রতিবাদের চেতনা ধারণ করি। আজকে আমরা সমবেত হয়েছি মৃত্যু ভয়হীন ফিলিস্তিনের গাজার জনগণের পাশে দাঁড়াতে।’
এরপর তিনি ঘোষণাপত্রের বিষয়াবলি ধারাবাহিকভাবে পাঠ করেন উপস্থিত জনগণের উদ্দেশ্যে। ‘মার্চ ফর গাজা’-এর ঘোষণাপত্রে চারটি স্তরে যেসব দাবি করা হয়েছে—
আমাদের প্রথম দাবিগুলো জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি ঘোষণা
যেহেতু জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সকল জাতির অধিকার রক্ষার, দখলদারিত্ব ও গণহত্যা রোধের সংকল্প প্রকাশ করে। আমরা দেখেছি, গাজায় প্রতিদিন যে রক্তপাত, যে ধ্বংস চলছে, তা কোনো একক সরকারের ব্যর্থতা নয় বরং এটি একটি আন্তর্জাতিক ব্যর্থতার ফল;
এই ব্যর্থতা শুধু নীরবতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং পশ্চিমা শক্তিবলয়ের অনেক রাষ্ট্র সরাসরি দখলদারকে অস্ত্র, অর্থ ও কূটনৈতিক সহায়তা দিয়ে এই গণহত্যাকে দীর্ঘস্থায়ী করেছে।
এই বিশ্বব্যবস্থা দখলদার ইসরাইলেকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে বরং রক্ষা করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
আমরা জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি বলছি-
—জায়নবাদী ইসরাইলের গণহত্যার বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে নিশ্চিত করতে হবে।
—যুদ্ধবিরতি নয়, গণহত্যা বন্ধে কার্যকর ও সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
—১৯৬৭ সালের পূর্ববর্তী ভূমি ফিরিয়ে দেয়ার জন্য বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে হবে।
—পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
—ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা, এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করতে হবে।
আমাদের দ্বিতীয় দাবিগুলো মুসলিম উম্মাহর নেতৃবৃন্দের প্রতি-
আমরা মুসলিম বিশ্বের সরকার ও ওআইসির মত বহুজাতিক সংগঠনগুলোর নিকট দৃঢ়ভাবে আহ্বান জানাই।
—ইসরাইলের সাথে অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সকল সম্পর্ক অবিলম্বে ছিন্ন করতে হবে।
—জায়নবাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে।
—গাজার মজলুম জনগণের পাশে সর্বাত্মক সহযোগিতা চিকিৎসা, খাদ্য, আবাসন ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে দাঁড়াতে হবে।
—আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসরাইলকে এক ঘরে করতে সক্রিয় কূটনৈতিক অভিযান শুরু করতে হবে।
—জায়নবাদী দোসর ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসনের অধীনে মুসলিমদের অধিকার হরণ, বিশেষ করে ওয়াক্ফ আইন সংশোধনের মতো রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ওআইসি ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে দৃঢ় প্রতিবাদ ও কার্যকর কূটনৈতিক অবস্থান নিতে হবে।
কারণ গাজার রক্তে লজ্জিত হওয়ার আগেই, গাজার পাশে দাঁড়ানোই উম্মাহর জন্য সম্মানের একমাত্র পথ। যে নেতৃত্ব আজ নীরব, কাল ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বাধ্য হবে।
আরো পড়ুন:
আমাদের তৃতীয় দাবিগুলো বাংলাদেশ সরকারের প্রতি-
বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র, যার স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তিতেই নিহিত রয়েছে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের চেতনা। আমরা বিশ্বাস করি, ফিলিস্তিনের প্রশ্নে বাংলাদেশ কেবল মানবতার নয় ইমানের পক্ষেও এক ঐতিহাসিক অবস্থানে আছে।
—বাংলাদেশি পাসপোর্টে ‘এক্সেপ্ট ইসরাইল’ শর্ত পুনর্বহাল করা, ইসরাইলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ার অবস্থান আরো সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে হবে।
—সরকারের ইসরাইলে যত প্রতিষ্ঠানের সাথে যত চুক্তি হয়েছে, তা বাতিল করতে হবে।
—রাষ্ট্রীয়ভাবে গাজায় ত্রাণ ও চিকিৎসা সহায়তা পাঠানোর কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
—সকল সরকারি প্রতিষ্ঠানে এবং আমদানি নীতিতে জায়নবাদী কোম্পানির পণ্য বর্জনের নির্দেশনা দিতে হবে।
—জায়নবাদী দোসর ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকারের অধীনে মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর চলমান নির্যাতনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিবাদ জানাতে হবে, যেহেতু হিন্দুত্ববাদ আজ শুধু একটি স্থানীয় মতবাদ নয় বরং আন্তর্জাতিক জায়নিস্ট ব্লকের অন্যতম দোসর।
—পাঠ্যবই ও শিক্ষা নীতিতে আল-আকসা, ফিলিস্তিন, এবং মুসলিমদের সংগ্রামী ইতিহাসকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মুসলিম আত্মপরিচয়ের সাথে গড়ে ওঠে।
আরো পড়ুন:
আমাদের সর্বশেষ দাবিগুলো নিজেদের প্রতি যা মূলত একটি অঙ্গীকারনামা—
—আমরা বয়কট করবো প্রত্যেক সেই পণ্য, কোম্পানি ও শক্তিকে যারা ইসরাইলের দখলদারিত্বকে টিকিয়ে রাখে।
—আমরা আমাদের সমাজকে প্রস্তুত করবো এমন নুরউদ্দীন, এমন সালাহউদ্দিন তৈরি করার জন্য যারা বাইতুল মাকদিসের মিম্বার পুনরুদ্ধার করবে।
—আমরা আমাদের সন্তানদের এমনভাবে গড়ে তুলবো যারা নিজেদের আদর্শ ও ভূখণ্ড রক্ষায় জান ও মালের সর্বোচ্চ ত্যাগে প্রস্তুত থাকবে।
—আমরা বিভাজিত হবো না কারণ আমরা জানি, বিভক্ত জনগণকে দখল করতে দেরি হয় না।
—আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকবো, যাতে এই বাংলাদেশ কখনো কোনো হিন্দুত্ববাদী প্রকল্পের পরবর্তী গাজায় পরিণত না হয়।
—আমরা শুরু করবো নিজেদের ঘর থেকে ভাষা, ইতিহাস, শিক্ষা, অর্থনীতি, সমাজ সবখানে এই অঙ্গীকারের ছাপ রেখে।
— আমরা মনে রাখবো গাজার শহীদরা কেবল আমাদের দো‘আ চান না তারা আমাদের প্রস্তুতি চান।