হাসপাতাল, বিআরটিএ থেকে পাসপোর্ট, কোথায় নেই হয়রানি!

সরকারি সেবা মানেই ভোগান্তি?

0

ঘুষ, কমিশন নয়তো ভোগান্তি, সরকারি সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে এটা যেন অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেসরকারি একটি সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, সেবা নিতে গিয়ে এখনও অন্তত ৭০ ভাগ মানুষকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুর্নীতির শিকার হতে হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সংকট জবাবদিহিতার অভাব। যদিও সংশ্লিষ্টদের দাবি, অভিযোগ আসলে শাস্তি পান কর্মকর্তারা।

ঢাকার আকাশ রৌদ্রোজ্জ্বল দেখে এখন টিভি বের হয়েছে এখানকার নাগরিকদের সেবা নিয়ে অভিজ্ঞতার খোঁজ নিতে। পথে যেতে দেখা যায় হঠাৎ বৃষ্টি। বৃষ্টি নিয়ে পূর্বাভাস করাটা যতটা সহজ, এখানকার উন্নয়ন নিয়ে শেষ কথা বলাটা ততটাই কঠিন। কারণ আজ হয়তো এ সড়ক ঠিকঠাক, কাল থেকে আবার খোঁড়াখুঁড়ি। শহরের একপ্রান্তের সঙ্গে অন্য প্রান্তের সেবা নিয়ে বৈষম্যের চিত্রটাও তো তৈরি হয়েছে সেবা সংস্থার হাত ধরে। কিন্তু ঢাকার বাইরেও কি এমন?

দেশের প্রধান নগর রাজধানী ঢাকায় সেবার প্রথম যে দৃশ্যপট রচনা করেছিল তা থেকে খুব বেশি ব্যতিক্রম হতে পারেনি অন্য নগরগুলো। সেখানেও নাগরিকদের সেবা পেতে অনেক মূল্য দিতে হয়।

স্বাস্থ্যসেবার খোঁজ-খবর নিতে রোগী হয়ে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়া‍র্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায় এখন টিভি।

সরকারি হাসপাতালে সেবা পেতে একজন মানুষকে কী কী অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তার একটি ধারণা নিতে এখানে যাওয়া। এটি রাজধানীর প্রধান হাসপাতালগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রথমে আউটডোরের পুরুষ টিকেট কাউন্টারে টিকিট কাটা থেকে শুরু করে ডাক্তার দেখানো পর্যন্ত একজন মানুষের কত সময় লাগে, কী কী প্রক্রিয়া আর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়- তার সচিত্র পাওয়া গেল।

হাসপাতালে টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়ে আছে রোগী ও তাদের স্বজনরা। ছবি: এখন টিভি

টিকিট কাটার লাইনটি অপেক্ষাকৃত ফাঁকা ছিল। কিন্তু ভেতরে ঢুকতেই সেবা পেতে আরও মানুষের মিছিল দাঁড়িয়ে ছিল। নির্ধারিত চিকিৎসকের কামরা ধরতে হবে। শেষ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া গেল।

একজন রোগীর সাথে কথা বললে তিনি জানান, আজকে ভিড় কম কিন্তু স্বাভাবিক সময়ে অনেক ভিড় থাকে।

এরই মাঝে বাকবিতণ্ডার চিত্র দেখা গেল, যদিও এটি নতুন কিছু নয় এখানে। যত ভিড় হয় তত বাড়ে হট্টগোল। লাইনে অপেক্ষার সারিতে আমরাও ক্লান্ত হয়ে যাই।

এর মধ্যে কয়েকজন রোগীর সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা অনেকে সকাল ৬টায় এসেছেন সিরিয়াল দেয়ার জন্য।

এখানকার আরও অভিজ্ঞতা নিতে চিকিৎসক দেখালে তিনি কয়েক ধরনের পরীক্ষা ধরিয়ে দিলেন। এসব পরীক্ষা এখানেই করানো যায়। সব মিলিয়ে ১০০টির বেশি রোগ পরীক্ষার সুযোগ রয়েছে এখানে।

কিন্তু এ সেবাটি পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় যাত্রীদের। এর কারণ শুধু সেবার পরিসরের চেয়ে সেবাগ্রহীতা কয়েকগুণ তা নয়- দায়িত্বহীনতা কিংবা স্বেচ্ছাচারিতাও এখানে বড় কারণ।

একজন রোগী বলেন, 'ওনারা এখন লাঞ্চের বিরতিতে গিয়েছে। বলেছে আসতে দেরি হবে।'

এই পরিস্থিতিতে পরীক্ষার জন্য টাকা জমা দিতে পারি নি আমরাও। যদিও সরকারি এই অনিশ্চিত সেবার বিপরীতে প্রান্তিক মানুষগুলোর জন্য তড়িৎ সেবার ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু সেটি কীভাবে?

রোগঅর হাতে প্রেসক্রিপশন ছাড়াও ধরিয়ে দেয়া অন্য স্লিপ। ছবি: এখন টিভি

মেজবাউল করীম রুবেল নামের বক্ষব্যাধির চিকিৎসক একজন রোগীকে একটা প্রেসক্রিপশন দিয়েছেন, তার সাথে একটি স্লিপও ধরিয়ে দিয়েছেন। তবে দেখে বোঝা গেল না কাগজটি কীসের। কাগজের পেছনে একটি নম্বর উল্লেখ করা আছে।

এ স্লিপের বিষয়ে রোগী বলেন, 'ওখানে এক্স-রে করার জন্য একজন লোককে দেখিয়ে দিয়ে বলেছেন তার কাছে কাগজ আছে। সেখানে গেলে তিনি এ কাগজ ধরিয়ে দেন। বলেছে এই কাগজ দেখালে পরীক্ষা করতে ৭০০ টাকা নেবে।'

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা ল্যাবের কর্ণধার বলেন, 'যেখানে ডাক্তাররা দল বেধে রোগী পাঠায়, আপনারা সেখানে যান। আমরা এ বিষয়ে কিছু জানি না।'

সবমিলিয়ে এ হাসপাতালে সেবার যে চিত্র দেখা যায় তা থেকে এই নগরীর অন্যান্য হাসপাতালগুলো এবং বেসরকারি হাসপাতালে সেবা নিতে গেলে সরকারি হাসপাতালের চেয়ে অনেকগুণ বেশি অর্থ খরচ হয়। যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রান্তিক এবং সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে বহন করা কঠিন বা অসম্ভব।

আমরা এই নগরীর অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর খবর জানবো, তবে তার আগে জেলা শহরগুলোর খবর নিয়ে আসা যাক । সেখানে কতটা সেবা পাচ্ছে মানুষ?

নানা ভোগান্তির পর শহরের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে মানুষ এ সেবা কিছুটা পেয়ে থাকে। কিন্তু প্রান্তিক এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া খুবই দুষ্কর। উপজেলাগুলোতে হাসপাতাল আছে কিন্তু ডাক্তার নেই। আবার ডাক্তার আসলে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও ওষুধের অভাবে চিকিৎসা সেবা হচ্ছে না। শহরে গেলে চিকিৎসা সেবা পাওয়া যাবে কিন্তু সেখানেও খরচের ভার।

একজন রোগী বলেন, 'উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলে বলে ডাক্তার নেই, পরে আসবে। আবার আসলেও টেস্ট করতে বলে নিজস্ব প্রাইভেট ক্লিনিক থেকে করার জন্য।'

কিন্তু সংকট কি শুধু স্বাস্থ্যসেবাতেই আছে? বয়সের ভারে নুয়েপড়া মানুষদের নিরাপত্তায় নেয়া সামাজিক ক‍র্মসূচিগুলো নিয়েও অনেক প্রশ্ন। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মাতৃত্বকালীন কিংবা প্রতিবন্ধী সেবা কীভাবে পেতে হয় তা জানেন না গ্রামের এসব ঝুঁকিতে থাকা মানুষেরা। এই যেমন খুলনার দাকোপের সত্তোরো‍র্ধ আফরোজা বেগমের কথাই ধরা যাক। বিধবা ভাতার জন্য উপজেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরে ধারণা দিয়ে নানা অজুহাতে দেখিয়ে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে তাকে।

আফরোজা বেগম বলেন, 'কোনো কাজ করতে পারি না, বয়স হয়ে গেছে। আমরা গরীব মানুষ, তোনো জায়গা-জমি নেই। সরকারের দেয়া জায়গায় থাকি। তাহলে আমরা যদি কিছু না পাই পাবে কে?'

এ শহরের উন্নয়ন আর নাগরিক সেবায় নিয়োজিত সিটি করপোরেশন, রাজউক কিংবা ওয়াসার মত করে করেই পুরেনা হচ্ছে গ্যাস ও সুপেয় পানির সংকট, অস্বাস্থ্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কিংবা প্রতি বর্ষায় নিয়ম করে আসা জলাবদ্ধতা। এখানে অনেক আলোচনার সমান্তরালে বেড়ে চলে মশার অনেক উপদ্রব।

এমন চিত্র যে শহরের বাইরেও খুব একটা আলাদা, তা নয়, তার উদাহরণ খুলনার আজিজুল ইসলাম। জীবনের সবটুকু সঞ্চয় দিয়ে ৫ শতক জায়গা কিনেছেন। নামপত্তন করবেন বলে সরকারি ভূমি অফিসের সব ফি'ই পরিশোধ করেছেন। কিন্তু অজানা এক কারণে মিলছেনা কাগজ।

আজিজুল বলেন, 'কষ্ট করে একটা জমি কিনেছি। এখন জমিটার নাম পরিবর্তন করার জন্য আসি। প্রায় ২ বছর হলে ঘুরতেছি। শেষ ৭ থেকে ৮ মাস হলে শুথু শুনতেছি এসিল্যান্ড আসেনি।'

জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা জন্ম নিবন্ধন, ইউনিয়ন পরিষদের জরুরি সেবাটি পেতেও অনেক ভুগতে হয় প্রান্তিক মানুষদের।

বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ডের দিনগুলোতেও গ্রামে নিয়ম করে চলে লোডশেডিং। সেবার বিপরীতে ভোগান্তির এ চিত্র আরও নির্মম হওয়ার কারণ ভুতুড়ে বিল। পাসপোর্ট সেবায় হয়রানির কথাও অনেক পুরনো। কিন্তু এখন কী পরিস্থিতি?

একজন সেবা গ্রহীতা বলেন, 'আগে তো সিরিয়ালই পেতাম না। দালাল ধরতে হতো। এখন তো লালাল ধরতে হয় না, নিজেরাই করা যায়। তবে একা করলে এতটু ঝামেলা হয়, তবে লোক ধরলে সুবিধা হয়। বসে থেকেই সব পাওয়া যায়। ওনারাই সব করে দেয়।'

ব্যবস্থাপনা এমন করা হয়েছে যে যারা নিজে থেকে কাজ করতে চান তারা সেটি করতে পারেন। তকবে, দালালের দৌঁড়াত্ম একেবারেই কমে যায়নি।

গোপন ক্যামেরা লাগিয়ে সিকিউরিটি গার্ডের মধ্যে একজন দালালের সঙ্গে কথা বলছেন এখন টিভির সাংবাদিক। ছবি: এখন টিভি

ঢাকার বিআরটিএ'র একটি অফিস ঘিরে যানবাহনের ভিড় কিংবা খুব কড়াকড়ির এই ড্রাইভিং টেস্ট দেখে মনে হতেই দালাল, দুর্নীতি আর তদবিরের ঘেরাটোপ থেকে হয়তো সংস্থাটি বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু এখানে বাস্তবতা ভিন্ন।

একজন ট্রাক ড্রাইভার বলেন, 'বিআরটিএতে টেবিলে টেবিলে টাকা দিতে হয়। ঘুষ না দিলে কাজ করে না। ঘুষ দিয়ে তারপর কাজ করতে হয়। এখানে কাজ করাতে হলে দালাল ধরতেই হবে।'

লক্করঝক্কর যানবাহনকে ফিটনেস প্রদান কিংবা টাকার বিনিময়ে লাইসেন্স প্রদান করা, ভেতর বাইরের কর্মকর্তা আর দালালদের দৌরাত্ম্যে সবই চলছে আপন গতিতে।

গোপনে সিকিউরিটি গার্ডের মধ্যে একজন দালালের কাছে আবেদনের কথা বললে তিনি বলেন, 'আপনি চাইলে আজকে আবেদন করে দিচ্ছি। তাহলে আপনার আলাদা করে বেশি সময় লাগবে না। সিরিয়াল করে দেবো আমি। এসে শুধু পরীক্ষা দিয়ে যাবেন। সবমিলিয়ে ১২ হাজার টাকা লাগবে।'

কিন্তু কেন এমন হয় তার জন্য উত্তর খুঁজছিল এখন টিভি।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও গ্রামীণ পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক প্রফেসর ড. মো. আশিক উর রহমান বলেন, 'মানুষ জানে না যে সরকারি সংস্থাগুলো কী সেবা দিচ্ছে। এখন সবকিছু ডিজিটাল সিস্টেমের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। সেখানেও একটা ব্যুরোক্রেটিক পদ্ধতি রাখা হয়েছে। কিছুটা ম্যানুয়াল রাখা হয়েছে আবার কিছুটা অটোমেশন রাখা হয়েছে। এই যে জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে সবকিছু তা আসলে বৈষম্য সৃাষ্ট করছে।'

দুর্নীতি নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ৩ বছর আগের একটি প্রতিবেদন বলছে, সেবা নিতে গিয়ে প্রায় ৭১ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতির শিকার হন। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না এই সূচকে সবচেয়ে এগিয়ে আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সেবাগুলো, এর পরপর আছে, পাসপোর্ট, ভূমি কিংবা বিচারিক সেবার খাতগুলো। কিন্তু মানুষকে সেবা দেবা জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে ঘুষ আর হয়রানির অনুশীলন কেন?

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী কিন্তু সরকারপ্রধান হিসেবে অসংখ্যবার সরকারি কর্মকর্তাদের বলেছেন, আপনারা জনগণের সেবক। বাস্তবতা এটা হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা এটা হয়ে গেছে যে সবার মধ্যে একটা কলোনিয়াল মাইন্ডসেট হয়েছে। এছাড়াও ঘুষ বা অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে যে অর্থ আদায় করা হয় সেটার জন্য জবাব দিহীতার কোনো জায়গা নেই।'

মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে সব মিলিয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর অনুদপ্তর ১ হাজারেরও বেশি সেবা প্রদান করে থাকে। এবং প্রতি বছর বাজেটে সরকার পরিচালনায় কর্মকর্তা বেতন ভাতায় সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ থাকে, তার অন্যতম লক্ষ্য মানুষের সেবা নিশ্চিত করা।

এসএস