মুহূর্তেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় নয় তলা অ্যাপার্টমেন্ট ভবন, মৃত্যুর মিছিলে যোগ হয় আরও কিছু নাম।
লেবাননের রাজধানী বৈরুতের দক্ষিণে ইসরাইলি বিমান হামলায় চালানো এ ধ্বংসলীলা আর হত্যাযজ্ঞের ঠিক আগে আগে আবাসিক ভবনটির বেইজমেন্টে বৈঠকে বসেছিলেন লেবাননের সশস্ত্র রাজনৈতিক সংগঠন হিজবুল্লাহ'র অভিজাত বাহিনী রাদওয়ানের কমান্ডাররা। ইসরাইলি যুদ্ধবিমানের আক্রমণে লাশ হয়ে বের হন নারী, শিশু, ১৬ হিজবুল্লাহ যোদ্ধা আর রাদওয়ানের দুই কমান্ডারসহ অর্ধশতাধিক মানুষ।
এ ঘটনার দু'দিন আগেই এক মিনিটে বিস্ফোরিত হয় হিজবুল্লাহ সদস্যদের ব্যবহৃত হাজারও ওয়াকিটকি। তার একদিন আগে পেজার বিস্ফোরিত হয়ে আহত তিন হাজার, পঙ্গু হয়ে চিকিৎসাধীন শত শত মানুষ। গেলো মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) থেকে শুরু হওয়া লেবাননজুড়ে ইসরাইলের ধারাবাহিক এসব গুপ্ত ও বিমান হামলায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা, লম্বা হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। পরিস্থিতির ভয়াবহতাই প্রমাণ করে, সবচেয়ে অন্ধকার সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ইরান সমর্থিত লেবাননভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ।
লেবাননের স্থানীয় একজন বলেন, 'সহ্যের সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে ইসরাইল। ওরা এমনই বিশ্বাসঘাতক, যারা আল্লাহকেও ভয় পায় না। তবে হিজবুল্লাহ এই যুদ্ধ শেষ করবে।'
৪০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আঘাতের শিকার বিশ্বের অন্যতম বড় অরাষ্ট্রীয় সশস্ত্র বাহিনীটির সামরিক অবকাঠামো। শুধু তাই নয়, দলের সব পর্যায়ে ছদ্মবেশী শত্রুদের দৃশ্যমান অনুপ্রবেশ আর যোগাযোগ অবকাঠামো ধ্বংসের ঘটনাও নজিরবিহীন।
লেবাননের নিরাপত্তা সূত্রের বরাত দিয়ে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, দলের ভেতরে ভয়াবহ মাত্রায় অনুপ্রবেশই হিজবুল্লাহ'র বিরুদ্ধে ইসরাইলের চলতি সপ্তাহের অভিযান সফল করেছে। এতে তীব্র আতঙ্ক আর অনাস্থা ছড়িয়েছে সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে, সন্দেহের মাত্রা এতোটাই তীব্র যে কাউকে ছবি তুলতে দেখলেও ফোন কেড়ে নিচ্ছেন সাদা পোশাকের হিজবুল্লাহ সদস্যরা।
স্থানীয় একজন বলেন, 'সবার আগে বলতে চাই, আমরা যেকোনো পরিস্থিতিতে যুদ্ধের বিরুদ্ধে। এই নির্মমতা আর সহ্য করতে পারছি না। এর আগে বন্দরে বিস্ফোরণে এক পা হারিয়েছি। হিজবুল্লাহ আগ্রাসন চালালে ইসরাইলও জবাব দেবে। এভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চলতেই থাকবে।'
বলা হচ্ছে, যোদ্ধা থেকে শুরু করে সামরিক নেতৃত্ব পর্যন্ত হিজবুল্লাহ'র পরতে পরতে অনুপ্রবেশ ঘটেছে ইসরাইলি গোয়েন্দাদের। সামরিক দুর্বলতা, তার ওপর গোপনীয়তার চাদর সরে যাওয়ায় ইসরাইলের বিরুদ্ধে কয়েক দশকের যুদ্ধের সবচেয়ে জটিল মোড়ে এসে পৌঁছেছে হিজবুল্লাহ। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে গাজার শাসকদল হামাসকে সহযোগিতার লক্ষ্যে ইসরাইলের সঙ্গে সীমান্তে সীমিত পরিসরে সংঘর্ষে জড়িয়েছিল হিজবুল্লাহ। কিন্তু অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকাতেও অস্ত্রবিরতি যেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। উল্টো ইসরাইলের সঙ্গে সীমিত পরিসরে সংঘাতের চরম মাশুল গুণতে হচ্ছে হিজবুল্লাহকে।
আগে থেকেই নানা প্রান্তে যুদ্ধকবলিত মধ্যপ্রাচ্য এবার হিজবুল্লাহ-ইসরাইল সংঘর্ষের জেরে আরও একটি আঞ্চলিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। তবে এতেও দমতে নারাজ হিজবুল্লাহ। বরং এটি যুদ্ধের নতুন অধ্যায় এবং এ যুদ্ধের শেষ দেখে ছাড়বেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন হিজবুল্লাহ'র সেকেন্ড ইন কমান্ড নাইম কাশেম।
তিনি বলেন, 'আমরা দেখছি যে হিজবুল্লাহও পাল্টা আঘাত করছে। শত্রুরা যদি যুদ্ধ চায়, আমাদের আর কী করার আছে। এ যুদ্ধ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। যুদ্ধ চাই না কিন্তু যুদ্ধ ছাড়া উপায়ও নেই।'
এরইমধ্যে ইসরাইলি ভূখণ্ড লক্ষ্য করে রোববার শক্তিশালী হামলা চালিয়েছে হিজবুল্লাহ। তাদের লক্ষ্য ছিল বিমানঘাঁটিসহ বেশ কিছু সামরিক স্থাপনা। ২০০৬ সালের লেবানন-ইসরাইল সর্বাত্মক যুদ্ধের পর ইসরাইলে হিজবুল্লারহ'র সবচেয়ে বড় আক্রমণ এটি। স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের পাশাপাশি এবার কিছুটা দূর পাল্লার মিসাইলও ছুঁড়ছে গোষ্ঠীটি।
লেবাননে ইসরাইলি আগ্রাসনে বিপর্যস্ত হিজবুল্লাহ'র প্রধান হাসান নাসরাল্লাহ'র মতে, একটা লড়াইয়ে হেরেছে হিজবুল্লাহ, পুরো যুদ্ধে নয়।