বৈশ্বিক অর্থনীতি থেকে শুরু করে ভূ-রাজনীতি, দুই ময়দানেই যুক্তরাষ্ট্র-চীন মধ্যকার আধিপত্য লড়াই বহু পুরোনো। ওয়াশিংটনকে টপকে বিশ্ব মোড়ল হওয়ার খায়েশ যেমন বেইজিংয়ের রয়েছে, তেমনি চীনকে পিছিয়ে রাখতে মরিয়া যুক্তরাষ্ট্রও। এভাবেই যুগ যুগ ধরে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেই পরিচিত চীন-যুক্তরাষ্ট্র।
চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীতার মধ্যেও ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যে পণ্য বাণিজ্য হয়েছে ৫৮ হাজার ৫০০ কোটি ডলার মূল্যের। যেখানে চীনের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে পণ্য আমদানি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে আগের বছরের তুলনায় দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি সাড়ে ২৯ হাজার কোটি ডলার।
এমন পরিস্থিতির মধ্যেই ২০২৫ সালে এসে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যে শুল্কযুদ্ধ পৌঁছেছে চরমে। যেখানে কেউ কাউকেই ছাড় দিতে নারাজ। কয়েকগুণ বাড়িয়ে পাল্টাপাল্টি শুল্ক কার্যকর করেছে উভয় পক্ষ।
এরইমধ্যে চীনকে বাদ দিয়ে বাকি দেশগুলোর ওপর আরোপ করা সম্পূরক শুল্ক ৯০ দিনের স্থগিত করায় ওয়াশিংটন-বেইজিং এর মধ্যকার বাণিজ্য যুদ্ধ উত্তেজনার পারদ এখন তুঙ্গে।
চীনা নেতা শি জিনপিং এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে এই শুল্কযুদ্ধ নতুন নয়। প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর ২০১৮ সালে চীন থেকে আমদানি করা সৌর প্যানেলের উপর ৩০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করেছিলেন ট্রাম্প।
দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে ধাপে ধাপে চীনা পণ্য আমদানিতে ১২৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর করলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার উপর জোর দিলে, এর শেষ দেখার হুঁশিয়ারি চীনের। তা শুধু নিজেদের স্বার্থে নয়, বরং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতি এবং বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থা রক্ষায় বাণিজ্য লড়াই থেকে পিছু হটতে চায় না বলে দাবি বেইজিংয়ের।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান বলেন, ‘চীন বাণিজ্য যুদ্ধ চায় না, তবে ভয়ও পায় না। আমরা জনগণের অধিকার এবং স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হতে দেব না। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা শুধু নিজস্ব স্বার্থ রক্ষার জন্য নয়। আমরা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতি এবং বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থাকেও পদদলিত হতে দেব না। যুক্তরাষ্ট্র যদি শুল্ক যুদ্ধ বা বাণিজ্য যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ওপর জোর দেয়, তবে চীন শেষ পর্যন্ত লড়াই করবে।’
চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্য সংঘাত আরও গভীর হচ্ছে। এ অবস্থায়, বিশ্লেষকেরাও মনে করছেন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নতি স্বীকার করবে না চীন। কারণ বেইজিং বিশ্বাস করে, ছাড়কে দুর্বলতা হিসেবে দেখেন ট্রাম্প। তাই নতি স্বীকার করা মানে নিজেদের জন্য বিপদ ডেকে আনা।
অন্যদিকে ট্রাম্পের এই শুল্কযুদ্ধকে অত্যন্ত বিপজ্জনক খেলা হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। যার কারণে অর্থনৈতিক ও ডলার আধিপত্যে যুক্তরাষ্ট্রের পতনের শঙ্কা বাড়ছে।
চীন গ্রো ইনভেস্টমেন্ট গ্রুপের প্রধান অর্থনীতিবিদ হং হাও বলেন, ‘ট্রাম্প তার বাণিজ্য অংশীদারদের কাছ থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছেন। যেখানে চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখছেন। তাই অত্যন্ত বিপজ্জনক খেলায় মেতেছেন। এই শুল্কযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিপক্ষের কাছ থেকে তিনি অনেক বেশি সুবিধা নিতে চাইছেন।’
চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৬ সালে মোট আমদানির পরিমাণ ২১ শতাংশ হলেও, দীর্ঘ বাণিজ্য বৈরিতায় ২০২৪ সালে তা কমে নেমে আসে ১৩ শতাংশে। বর্তমানে শুল্কযুদ্ধ চরম পর্যায় পৌঁছানোয় ওয়াশিংটন আমদানি আরও কমিয়ে দিলে বেইজিং ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে শঙ্কা অনেক বিশ্লেষকের। তাই অন্যান্য বাজার দিয়ে চীন এই ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এমনকি অন্য দেশ হয়ে চীনা পণ্যই যুক্তরাষ্ট্রে পুনঃরপ্তানির সম্ভাবনাও প্রকট বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক।