আন্তর্জাতিক বাণিজ্য
0

লোহিত সাগরে ঝুঁকি কমছে না, আরও বাড়বে পণ্য পরিবহন সংকট!

হুতি বিদ্রোহীদের হামলা আতঙ্কে বিশ্ব বাণিজ্যের অন্যতম পথ লোহিত সাগর দিয়ে জাহাজ চলাচল এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বিকল্প পথে কন্টেইনার পরিবহনে বাড়ছে খরচ, প্রভাব পড়ছে মূল্যস্ফীতিতে। পথ দীর্ঘ হওয়ায় পণ্য বাণিজ্য স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজন পড়ছে নতুন জাহাজ আর কন্টেইনারের। পানামা খালের পানি কমে যাওয়ায় আরও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিশ্ব বাণিজ্য। পণ্য পরিবহন ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, সক্ষমতা বাড়ানোর প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদী হওয়ায় বিশ্ববাজারে আরও বাড়বে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন খরচ।

বিশ্ব বাণিজ্যে লোহিত সাগরের অবস্থান সবসময় গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু গেলো ৬ মাস ধরে ইসরাইলের সঙ্গে জাহাজ মালিকরা সম্পর্কিত দাবি করে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা এই সাগরে চলাচলকারী জাহাজগুলোতে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে গেলো ২০ জুন ড্রোন হামলা চালিয়ে কয়লাবাহী একটি জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছে হুতি বিদ্রোহীরা।

হুতিদের এই হামলার জবাবে লোহিত সাগরে সামরিক নৌযান মোতায়েন করে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র আর ব্রিটেনের নৌবাহিনী। সঙ্গে সমুদ্রের এই অঞ্চল জাহাজ চলাচলের জন্য নিরাপদ রাখতে আন্তর্জাতিকভাবে মোতায়েন করা আছে রণতরী। এরপরও নিরাপত্তা পুরোপুরি নিশ্চিত না হওয়ায় বাড়ছে জাহাজ চলাচলে খরচ।

অক্টোবরে হামাস-ইসরাইল সংঘাত শুরুর পর থেকেই অস্থির হয়ে আছে বিশ্ব বাণিজ্য। এর মধ্যে লোহিত সাগরে এই সংঘাত মালবাহী জাহাজ চলাচলে খরচ আর বাণিজ্যিক জাহাজে পণ্য পরিবহনে ইন্স্যুরেন্স খরচ বাড়ছে। জাহাজ হারানোর ভয়ে জাহাজ মালিকরা দাবি করছে মোটা অঙ্কের ইন্সুরেন্স বা ক্ষতিপূরণ।

নিরাপত্তার স্বার্থে সুয়েজ খাল বাদ দিয়ে জাহাজ চলছে কেপ অব গুড হোপ দিয়ে। এর সাথে বেড়ে গেছে ভ্রমণের সময় আর জ্বালানির খরচ। পণ্য পরিবহন ব্যবস্থাপনায় কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, বাণিজ্য পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ এই মেরুদণ্ডের কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় বিশ্বে সমুদ্রপথে বাণিজ্য কমেছে আশঙ্কাজনকহারে।

মালবাহী জাহাজ চলাচল তদারকি প্রতিষ্ঠান ড্রিওরি ওয়ার্ল্ড কন্টেইনার ইনডেক্সের তথ্য বলছে, জুনের তৃতীয় সপ্তাহেই ৪০ ফুটের কন্টেইনারের শিপিং খরচ বেড়ে গেছে ৭ শতাংশ। বছর ব্যববধানে এই কন্টেইনার পরিবহনে খরচ পড়ছে ২৩৩ শতাংশ বেশি। এরমধ্যেই চলছে আরও নিরাপদ সমুদ্রপথ খুঁজে বের করার চেষ্টা।

তবে লন্ডনের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ক্যাপিটল ইকোনমিক্স বলছে, জাহাজের মালিকরা বিকল্প পথের খোঁজে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। কিন্তু পণ্য পরিবহনে খরচ কমছে না। এই বছরও জাহাজগুলো কেপ অব গুড হোপ দিয়ে চলাচল করলে আরও বাড়বে সমুদ্রে পণ্য পরিবহন খরচ। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সম্মেলন আঙ্কটাড বলছে, আফ্রিকা দিয়ে জাহাজগুলো ঘুরিয়ে নিতে হয় বলেই এতো বাড়ছে খরচ।

পাশাপাশি সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজন পড়ছে অতিরিক্ত জাহাজের। ২০২২ সালে কন্টেইনার পরিবহনের দূরত্বের তুলনায় ২০২৪ সালে দুরত্ব বেড়েছে ৯ শতাংশ পর্যন্ত। কন্টেইনারবাহী জাহাজগুলো সমুদ্রে বেশি সময় থাকায় প্রয়োজন পড়ছে নতুন আরও কন্টেইনার ও জাহাজ। কোম্পানিগুলোকে হয় কন্টেইনার কিনতে হচ্ছে, না হয় ভাড়া নিতে হচ্ছে। ফলে আরও বাড়ছে পণ্য সরবরাহ খরচ। জাহাজের সমুদ্রে বেশি সময় থাকার আর দ্রুতগতিতে চলার কারণে বাড়ছে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ।

আঙ্কটাড বলছে, শুধু মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তা ইস্যুতে নয়, বিশ্ব বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পানামা খালে পানি কমে যাওয়ায়। এই সমুদ্রপথ পুরোপুরি ব্যবহার করতে না পারায় পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সমুদ্রপথ ব্যবহার করতে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে। দেশের মধ্যে পশ্চিম থেকে পূর্ব উপকূলে পণ্য নিতে ব্যবহার করতে হচ্ছে স্থলপথ। এর মধ্যে গম বা এলএনজি পরিবহনে মাঝে মাঝে যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যবহার করতে হচ্ছে দক্ষিণ আমেরিকার ঝুঁকিপূর্ণ স্থলপথ কেপ হর্ন।

সংবাদ মাধ্যম ব্লুমবার্গের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বাণিজ্যিক পথ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে লোহিত সাগর। ৭০ শতাংশ বাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে আফ্রিকা দিয়ে। এই সংকট চলতে থাকলে ভবিষ্যতে আরও বাড়বে জাহাজে পণ্য পরিবহন খরচ। সংবাদ মাধ্যম ডয়েচে ভ্যালে বলছে, জাহাজ তৈরিতে প্রয়োজন হয় কয়েক বছরের, নতুন কন্টেইনারের ৯০ শতাংশই তৈরি হয় চীনে। তাই সক্ষমতা রাতারাতি বাড়ানো সম্ভব নয়। সমুদ্র পথে পণ্য পরিবহনে সংকট ভবিষ্যতে আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন তারা।

এসএস