কিডনি সুস্থতার গোপন সূত্র: মূত্রের সঠিক পরিমাণ (Symptoms of protein leakage in urine)
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিডনির কার্যকারিতা বোঝার জন্য মূত্রের পরিমাণ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক। সাধারণত, যদি দিনে ১০ ঘণ্টার মধ্যে আপনার শরীরের ওজন অনুযায়ী প্রতি কেজিতে ০.৫ থেকে ১ মিলিলিটার মূত্র (Urine Volume) বের হয়, তবে তা কিডনি ভালো কাজ করছে এমন লক্ষণ।
উদাহরণস্বরূপ: আপনার ওজন যদি ৬০ কেজি হয়, তাহলে ১০ ঘণ্টায় আপনার কমপক্ষে ৩০০ মিলিলিটার থেকে ৬০০ মিলিলিটার মূত্র হওয়া স্বাভাবিক। এই পরিমাপের গড় আপনাকে আপনার কিডনি ফাংশন টেস্ট সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দেবে। সুস্থ কিডনির লক্ষণ হিসেবে আপনার প্রস্রাব হবে স্বাভাবিক ও স্বচ্ছ, শরীরে থাকবে পর্যাপ্ত শক্তি এবং কোনো ফোলা ভাব বা দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি থাকবে না।
ঘরে বসে কিডনি পরীক্ষার সহজ ধাপ: ১০ ঘণ্টায় মূত্র পরিমাপ করবেন যেভাবে(Simple steps for kidney test at home)
এই পরীক্ষাটি একেবারেই সহজ এবং নন-ইনভেসিভ। পদ্ধতিটি নিচে ধাপে ধাপে দেওয়া হলো(Urine volume test to check kidney health):
সময় নির্বাচন: এমন একটা ১০ ঘণ্টার সময় বেছে নিন, যখন আপনি নিয়ম করে মূত্র পরিমাপ করতে পারবেন।
পাত্র প্রস্তুত: এক লিটারের মতো পরিষ্কার বোতল বা মাপার পাত্র নিন।
সংগ্রহ ও পরিমাপ: এই সময়ের মধ্যে যতবার মূত্র হবে, তা পরিমাপের পাত্রে সংগ্রহ করে শেষে মোট পরিমাণটি হিসাব করুন।
ফলাফল যাচাই: আপনার ওজন অনুযায়ী যে পরিমাণ হওয়ার কথা ছিল, তার সঙ্গে মোট পরিমাণের তুলনা করুন।
বিশেষ করে, যদি আপনার ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ (High Blood Pressure) থাকে বা আপনি নিয়মিত ব্যথানাশক ওষুধ (NSAIDs) খান, তবে মাসে একবার বা দুবার এই পরীক্ষা করা উচিত। কারণ এসব কারণে কিডনি ড্যামেজ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। (Dietary restrictions for calcium oxalate kidney stones)
মূত্র কম হওয়ার অর্থ কী?
যদি আপনার মূত্রের পরিমাণ নিয়মিত কম হয়, তাহলে তা হতে পারে কিডনির কাজ ঠিকভাবে না হওয়ার বা শরীর থেকে ঠিকমতো বর্জ্য বের না হওয়ার লক্ষণ। এর পেছনে কিছু কারণ থাকতে পারে—যেমন শরীরে পানি কমে যাওয়া, কিডনিতে ঠিকমতো রক্ত না পৌঁছানো, অথবা কিডনি রোগের প্রাথমিক সমস্যা শুরু হওয়া। ন্যাশনাল কিডনি ফাউন্ডেশন (National Kidney Foundation) বলছে, হঠাৎ মূত্র কমে যাওয়া হলো 'অ্যাকিউট কিডনি ইনজুরি' (Acute Kidney Injury)-এর প্রধান লক্ষণ।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, নিচের ৫টি গুরুত্বপূর্ণ উপসর্গ বা পরিবর্তন দেখা দিলেই কিডনি পরীক্ষা করুন:
- প্রস্রাবের অভ্যাসে অস্বাভাবিক পরিবর্তন (Abnormal Urinary Changes)
- হাত, পা ও মুখ ফুলে যাওয়া (Edema / Swelling)
- চরম ক্লান্তি ও দুর্বলতা (Chronic Fatigue and Weakness)
- শুষ্ক ত্বক ও চুলকানি (Dry Skin and Uremic Pruritus)
- পিঠে ব্যথা ও ঘুমের সমস্যা (Flank Pain and Insomnia)
এগুলি প্রাথমিক কিডনি রোগের লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত।
১. প্রস্রাবের অভ্যাসে অস্বাভাবিকতা ও ফেনা বৃদ্ধি
কিডনি যখন সঠিকভাবে রক্ত ফিল্টার করতে পারে না, তখন প্রস্রাবের পরিবর্তন ঘটে। এটিই কিডনি সমস্যার সবচেয়ে স্পষ্ট লক্ষণ।
ঘন ঘন প্রস্রাব: বিশেষ করে রাতে একবারের বেশি টয়লেটে যেতে হলে সতর্ক হন।
ফেনাযুক্ত প্রস্রাব: প্রস্রাবে যদি অতিরিক্ত ও স্থায়ী ফেনা দেখা যায়, তবে তা প্রোটিন লিকের (Proteinuria) ইঙ্গিত দেয়। অর্থাৎ, কিডনি আপনার শরীর থেকে প্রোটিন ফিল্টার করে বাইরে বের করে দিচ্ছে।
রং পরিবর্তন: গাঢ় হলুদ বা বাদামী রং অথবা প্রস্রাবের সাথে সামান্য রক্তের উপস্থিতি বিপদ সংকেত।
আরও পড়ুন: লিভার:
২. হাত, পা ও মুখমণ্ডল ফুলে যাওয়া
যখন কিডনি শরীর থেকে অতিরিক্ত জল, লবণ বা সোডিয়াম বের করতে পারে না, তখন সেই তরল শরীরে জমতে শুরু করে। প্রথমেই পায়ের পাতা, গোড়ালি এবং চোখের নিচে এই ফোলা ভাব (Edema) দেখা যায়। এটি দীর্ঘ সময় ধরে থাকলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি।
৩. চরম ক্লান্তি, দুর্বলতা ও রক্তস্বল্পতা
কিডনি আমাদের দেহের জন্য অত্যন্ত জরুরি একটি হরমোন (এরিথ্রোপোয়েটিন) তৈরি করে, যা রক্তকণিকা উৎপাদনে সাহায্য করে। কিডনি দুর্বল হলে এই হরমোন উৎপাদন কমে যাওয়ায় শরীরে অ্যানিমিয়া (রক্তস্বল্পতা) দেখা দেয়। এর ফলে রোগী অল্প পরিশ্রমেও চরম ক্লান্তি ও দুর্বলতা অনুভব করেন এবং কাজে মনোযোগ কমে যায়।
৪. তীব্র চুলকানি এবং শুষ্ক ত্বক
রক্তে টক্সিন জমা হওয়া বা ইউরেমিয়া (Uremia) কিডনি রোগের একটি প্রধান উপসর্গ। কিডনি তার ফিল্টারের কাজটি বন্ধ করলে রক্তে বিষাক্ত পদার্থ জমা হয়। এই টক্সিনগুলো ত্বকের নিচে জমা হয়ে ত্বক অতিরিক্ত শুষ্ক করে দেয় এবং সারা শরীরে তীব্র চুলকানি বা র্যাশ সৃষ্টি করতে পারে।
৫. পিঠে ব্যথা এবং মনোযোগের অভাব
কিডনিজনিত সমস্যায় পিঠের পাশে (Flank Area), পাঁজরের ঠিক নিচে ব্যথা অনুভূত হতে পারে। এটি কিডনিতে সিস্ট বা সংক্রমণের লক্ষণ হতে পারে। এছাড়াও, মস্তিষ্কে টক্সিন জমা হওয়ার কারণে অনেকে অনিদ্রা (Insomnia) বা ঘুমের সমস্যা এবং স্মৃতিশক্তির দুর্বলতায় ভোগেন।
এই লক্ষণগুলি কোনো নিশ্চিত রোগ নির্ণয় নয়। যদি আপনি উপরের কোনো কিডনি রোগের উপসর্গ বা একাধিক পরিবর্তন লক্ষ্য করেন, তবে দেরি না করে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং দ্রুত ল্যাব টেস্ট করান। কিডনি ভালো রাখার উপায় সম্পর্কে সচেতন থাকুন।
ঘরে বসে কিডনি পরীক্ষা করানোর উপকারিতা কী?
ঘরে বসে কিডনি পরীক্ষা (অর্থাৎ উপসর্গ পর্যবেক্ষণ) করানোর প্রধান উপকারিতা হলো:
প্রাথমিক সতর্কতা: এটি কোনো ব্যয়বহুল বা জটিল ল্যাব টেস্টের আগেই আপনাকে কিডনি রোগের প্রাথমিক লক্ষণ সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়।
খরচ সাশ্রয়: নিয়মিত ল্যাব টেস্টের প্রয়োজন হয় না, ফলে খরচ সাশ্রয় হয়।
দ্রুত সচেতনতা: শরীরের ছোটখাটো পরিবর্তনগুলো দ্রুত নজরে আসে, যা তাড়াতাড়ি চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে সাহায্য করে।
নন-ইনভেসিভ: এটি কোনো ইনভেসিভ পদ্ধতি নয়, যা সম্পূর্ণ নিরাপদ।
আরও পড়ুন:
কারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে?
বর্তমান জীবনযাত্রায় কিছু মানুষ বিশেষভাবে কিডনি ড্যামেজ (Kidney Damage) হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন। আপনি যদি ডায়াবেটিস (Diabetes) বা উচ্চ রক্তচাপের (High Blood Pressure) রোগী হন, অথবা আপনার পরিবারে কিডনি রোগের ইতিহাস থাকে, তবে আপনাকে আরও সতর্ক থাকতে হবে। কিডনি সুস্থ রাখতে আপনার দৈনন্দিন রুটিনে কিছু স্বাস্থ্য টিপস (Health Tips) মেনে চলা আবশ্যক। যেমন—পর্যাপ্ত পানি পান করা, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, অতিরিক্ত লবণ ও চিনি পরিহার করা এবং ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ব্যথানাশক ওষুধ (NSAIDs) একেবারেই না খাওয়া। এই অভ্যাসগুলো আপনার কিডনিকে দীর্ঘমেয়াদী চাপ থেকে রক্ষা করবে।
কিডনিতে পাথর হলে কী খাবেন না?
যাদের কিডনিতে পাথর (Kidney Stones) ধরা পড়েছে, তাদের জন্য খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি। সাধারণত, অতিরিক্ত লবণ (সোডিয়াম), রেড মিট (Red Meat), অতিরিক্ত চিনিযুক্ত পানীয় এবং উচ্চ অক্সালেটযুক্ত খাবার (যেমন: পালংশাক, চকলেট, বাদাম) অবশ্যই এড়িয়ে চলতে হবে। পাথরের ধরন ভিন্ন হতে পারে, তাই আপনার জন্য সঠিক খাদ্য নির্দেশনা (Dietary Restrictions) জানতে একজন বিশেষজ্ঞ পুষ্টিবিদের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এই সহজ সতর্কতাগুলো মেনে চললে আপনি আপনার কিডনিকে সুস্থ রাখতে পারবেন এবং স্বাস্থ্য নিয়ে দুশ্চিন্তা কমবে।
কিডনি নিয়ে বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্নোত্তর-FAQ
প্রশ্ন: কিডনি ঠিক আছে কিনা কিভাবে বুঝবো?
উত্তর: সুস্থ কিডনির লক্ষণ হলো: স্বাভাবিক পরিমাণে পরিষ্কার প্রস্রাব হওয়া (১০ ঘণ্টায় শরীরের প্রতি কেজিতে ০.৫-১ মিলিলিটার), শরীরে কোনো ফোলা ভাব না থাকা, ক্লান্তিহীন থাকা এবং রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকা।
প্রশ্ন: বাড়িতে কিডনি টেস্ট করা যায় কী?
উত্তর: বাড়িতে রক্ত বা ইউরিন টেস্ট করা যায় না। তবে উপসর্গ পর্যবেক্ষণ করা যায়। যেমন—প্রস্রাবের পরিমাণ মেপে দেখা (বিশেষজ্ঞদের দেওয়া সূত্র অনুযায়ী), শরীরে ফোলা ভাব বা ফেনা যুক্ত প্রস্রাব হচ্ছে কি না তা খেয়াল করা।
প্রশ্ন: ঘরে বসে কিডনি ইনফেকশন টেস্ট করা যায়?
উত্তর: না। কিডনি ইনফেকশন (UTI) নিশ্চিতভাবে জানতে ইউরিন কালচার (Urine Culture) সহ ল্যাবরেটরি টেস্ট করা আবশ্যক। ঘরে বসে শুধু তীব্র ব্যথা, জ্বর বা ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার মতো লক্ষণগুলো পর্যবেক্ষণ করা যায়।
প্রশ্ন: ঘরোয়া পদ্ধতিতে কিডনি নষ্ট হওয়ার লক্ষণ?
উত্তর: কিডনি নষ্ট হওয়ার প্রাথমিক লক্ষণগুলো হলো: পা, গোড়ালি ও মুখ ফোলা, চরম ক্লান্তি, প্রস্রাব কমে যাওয়া, প্রস্রাবে রক্ত বা ফেনা দেখা এবং বমি বমি ভাব।
প্রশ্ন: কিডনি ঠিকমতো কাজ না করার ৫টি লক্ষণ?
উত্তর: ঘন ঘন বা কমে যাওয়া প্রস্রাব, পা ও মুখ ফুলে যাওয়া, চরম দুর্বলতা/ক্লান্তি, বমি বমি ভাব, এবং ত্বকে চুলকানি বা শুষ্কতা।
প্রশ্ন: সুস্থ কিডনির লক্ষণ কী কী?
উত্তর: প্রস্রাব স্বাভাবিক পরিমাণে হওয়া, শরীরে কোনো অপ্রত্যাশিত ফোলা ভাব না থাকা, স্বাভাবিক রক্তচাপ থাকা এবং শক্তি বজায় থাকা।
প্রশ্ন: কিডনি ব্লকের লক্ষণ কী কী?
উত্তর: তীব্র পিঠে বা পেটে ব্যথা, প্রস্রাবে রক্ত, জ্বর, এবং মূত্রাশয় থেকে প্রস্রাব বের হতে না পারার অনুভূতি।
প্রশ্ন: কিডনিতে পানি জমার লক্ষণ কী কী?
উত্তর: কিডনিতে পানি জমা (Hydronephrosis) হলে সাধারণত পিঠের পাশে তীব্র ব্যথা হয়, প্রস্রাবের সময় ব্যথা হয় এবং কিছু ক্ষেত্রে জ্বর ও বমি ভাব হতে পারে।
প্রশ্ন: কিডনিতে পানি জমলে কী খাবার খেতে হবে?
উত্তর: কিডনিতে পানি জমার মূল কারণের চিকিৎসা জরুরি। তবে খাদ্য হিসেবে কম লবণযুক্ত (Low Sodium) খাবার খেতে হবে এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী তরল পানের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
প্রশ্ন: কী কী খাবার খেলে কিডনি ভালো থাকে?
উত্তর: প্রচুর পরিমাণে জল, সবুজ শাকসবজি, বেরি জাতীয় ফল (যেমন: স্ট্রবেরি), কম লবণযুক্ত খাবার এবং চর্বিহীন প্রোটিন (Lean Protein) খেলে কিডনি ভালো থাকে।
প্রশ্ন: কিডনির নরমাল পয়েন্ট কত?
উত্তর: কিডনির কার্যকারিতা সাধারণত GFR (Glomerular Filtration Rate) দিয়ে মাপা হয়। স্বাভাবিক GFR হলো ৯০ ml/min বা তার বেশি। রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা (Creatinine Level) ১.২ mg/dL এর নিচে থাকা ভালো।
প্রশ্ন: পেঁপে কি কিডনির জন্য ভালো?
উত্তর: হ্যাঁ, পেঁপেতে থাকা ভিটামিন এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কিডনির স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। এটি হজমে সহায়তা করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
প্রশ্ন: কিডনিতে পাথর হলে কি কি খাওয়া যাবে না?
উত্তর: পাথরের ধরনের ওপর নির্ভর করে। ক্যালসিয়াম অক্সালেট পাথর হলে অতিরিক্ত অক্সালেটযুক্ত খাবার (যেমন: পালংশাক, চকলেট, বাদাম), অতিরিক্ত লবণ এবং প্রাণীজ প্রোটিন সীমিত করতে হবে।





