বিশেষ প্রতিবেদন
পরিবেশ ও জলবায়ু
0

দুর্যোগকবলিত হয়ে শহরমুখী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে ঠিকানা বদলায় প্রান্তিক মানুষের, ছাড়তে হয় পুরানো ভিটে। কিন্তু শহরমুখী এসব মানুষের দুর্ভাগ্য পিছু ছাড়ে না। মেলে না নাগরিক সুযোগ-সুবিধা। উন্নয়ন সংস্থাগুলো বলছে, প্রান্তিক অঞ্চলে টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে জলবায়ু অভিঘাতগ্রস্ত মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে নিতে হবে কার্যকর নীতি।

রোজগারের এই ঢাকা শহরে নিত্যদিন কত মানুষের আসা যাওয়া। প্রান্ত থেকে কেন্দ্র, অবিরাম ছুটে চলা। এ শহর স্বপ্ন দেখায় জীবিকার। সেই টানে কারো মাথা গোজার ঠাঁই মেলে, কেউবা আকাশকেই বানিয়ে নেন ছাদ।

নগরে আসা মানুষদের একটা বড় অংশ দুর্যোগকবলিত। যাদের অধিকাংশের বসত রাজধানীর বস্তিগুলোতে।

নদী গ্রাসে ভেসে গেছে মাহমুদা আক্তারের সংসারের ভেলা। সব হারিয়ে রাজধানীতে ছোট ঘরেই এখন তিন সন্তান নিয়ে কোনোমতে চলা। একসময় গৃহকর্মীর কাজ করলেও অসুস্থতায় তাও বন্ধ হয়ে আছে। রসুইঘরে খাবারের যে জোগাড়-যন্ত্র তাতে স্পষ্ট দারিদ্র্যের ছাপ।

নদী ভাঙনে বাড়িঘর হারানো মাহমুদা আক্তার। ছবি: এখন টিভি

মাহমুদা আক্তার বলেন, 'আমার শ্বশুর বাড়ি ভাঙার পর অন্য জায়গায় গিয়ে উঠেছিলাম। কয়েক বছর পর সেটাও ভেঙে যায় তারপর আমরা ঢাকা আসি। কথা ছিল আমার জামাই ঢাকা এসে কামকাজ করবে। কিন্তু আসার পরই উনি প্যারালাইসিস হয়ে মারা যায়। আমি অনেকদিন কাজ করলাম এখন আমিও অসুস্থ।'

রাজধানীর বস্তিগুলোতে এমন হাজারও পরিবারের শেকড় ছেড়ে আসার গল্প কান পাতলেই শোনা যায়। এখানে যারা আসেন তাদের বেশিরভাগই জলবায়ু অভিবাসী। এই শহরে জলবায়ু তহবিল নিয়ে ভারি ভারি আলাপ শোনা গেলেও তাদের জীবনমানে কোনো বদল আসে না।

বস্তিতে থাকা একজন বলেন, 'বাড়িতে পানি উঠে গেলে আমার বাপ-মা সবাই বাশের ঝাড়ের মধ্যে গিয়ে উপরে ছিলাম আমরা। তখন তো নদী ভেঙে সব চলে যায়। পরে আমরা ঢাকা চলে আসি।'

বস্তিতে থাকা অন্য আরেকজন বলেন, 'এখন আমার ঘরদুয়ার নেই। আমার বোনের ঘরে একটু ঘুমাই এখন। বাচ্চাদের চলাফেরার মতো আমরা সেই পরিবেশ দিতে পারি না। যতটুকু জায়গার মধ্যে আমরা থাকি সেটা একটা গৃহবন্দির মতো থাকি।'

গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, বন্যার কারণে সর্বোচ্চ ৩৪ শতাংশ মানুষ স্থানচ্যুত হয়ে শহরমুখী হন। ২৭ শতাংশ মানুষ নিঃস্ব হন নদীভাঙনে। বাস্তুচ্যুত হওয়া ৫১ শতাংশ নারী রাজধানীতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন। বাকিরা যুক্ত হন গার্মেন্টস, বর্জ্য সংগ্রহকারী, দিনমজুর ও অন্যান্য কাজে।

জলবায়ু অর্থায়ন বিশেষজ্ঞ জাকির হোসেন খান বলেন, 'কেউ কিন্তু তার শিকর থেকে সরে যেতে চায় না। যখন একেবারে শেষ সীমায় এসে পৌঁছায়, তখন সে বাধ্য হয় ওই এলাকা থেকে চলে আসার জন্য। ওই এলাকা উপযোগী আমরা যদি কোনো একটা ব্যবস্থা করে দিতে চাই, তাহলে সে সেখানে টিকে থাকবে। সে যুদ্ধ করে হলেও টিকে থাকবে। কারণ সে জানে সেটাই তার আশ্রয়স্থল, সেটাই তার বেঁচে থাকার একমাত্র জায়গা।'

ব্র্যাকের ক্লাইমেট চেঞ্জ প্রোগ্রামের প্রোগ্রাম হেড আবু সাদাত মুনীরুজ্জামান খান বলেন, 'ক্লাইমেট ডিসপ্লেসমেন্ট নিয়ে যে ডিস্কোর্স, এখানে কিন্তু আমাদের কোনো রোড ম্যাপ নেই। ই মানুষগুলো কি ঢাকাতেই ফাইনালি থাকবে? মার দৃষ্টিতে বিষয়টা হলো বাস্তুচ্যুতরা ঢাকায় আসা কোনো সমাধান হতে পারে না।'

গ্লোবাল রিপোর্ট অন ইন্টারন্যাল ডিসপ্লেসমেন্ট'র এক পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৮২ লাখ। যার মধ্যে পরিবেশগত দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত প্রায় ২৯ লাখ মানুষ। বাংলাদেশে এই সংখ্যা ৫৫ হাজার।

অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ স্থানচ্যুতি ঘটেছে ৩৭ লাখ মানুষের। যার মধ্যে দুর্যোগের প্রভাব পড়েছে ৩৬ লাখ মানুষের ওপর। বাংলাদেশে স্থানচ্যুতির সংখ্যা সর্বোচ্চ প্রায় ১৮ লাখ। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে পাকিস্তান, যাদের বাস্তুচ্যুতির সংখ্যা ৭ লাখ। আর ভারতে এই সংখ্যা ৫ লাখের কিছু বেশি।

উন্নয়ন সংস্থাগুলো বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে খাদ্যাভাব, কর্মহীনতা, স্বাস্থ্য ঝুঁকিসহ যেসব সংকট তৈরি হচ্ছে তা নিরসনে বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারের নজরদারি দরকার।

আইলা, সিডর কিংবা বন্যার মতো বড় বড় দুর্যোগের পর জলবায়ু অভিবাসনের হার আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে যায়। অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, প্রান্তিক অঞ্চলে টেকসই উন্নয়ন আর সহায়তা বাড়ানোর মাধ্যমে বাস্তুচ্যুতদের ঝুঁকি কমানো জরুরি।

ওকাপের নির্বাহী পরিচালক শাকিরুল হক বলেন, 'তাদেরকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য, তারা টিকে থাকার জন্য তাদের একটা নিয়মিত সাপোর্ট দরকার। অথবা তাদের অ্যাডাপটেশনের কথা যেটা বলছি, সেগুলোর জন্য একটা লং টার্ম পলিসি থাকা দরকার।'

সংকট নিরসনে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির সাথে খাপ খাওয়ানো ও জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন করতে কার্যকর নীতি, কৌশল ও অ্যাকশন প্ল্যান নির্ধারণে কাজ করার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের।

এসএস