জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন- ২০২৪ বা কপ টোয়েন্টি নাইনের গ্রহণযোগ্যতা বা উপযোগিতা নিয়ে বারবার প্রশ্ন তুলেছেন অনুন্নত দেশের নেতারা। ক্ষতিপূরণ নাকি ঋণ- অনুন্নত দেশগুলো জলবায়ু সম্মেলনে কী চাইতে আসে- এ নিয়েও ছিল তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। আর শেষ পর্যন্ত জলবায়ু চুক্তি নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হলে- কপ টোয়েন্টি নাইন ব্যর্থ হয়েছে- এমন গুঞ্জনও ওঠে নানা মহলে।
এমন বাস্তবতায় নতুন জলবায়ু চুক্তি চূড়ান্ত করতে শনিবার আজারবাইজানের বাকুতে বৈঠকে বসে অংশগ্রহণকারী প্রায় দুইশো দেশের প্রতিনিধি। সমঝোতা আলোচনা মনঃপূত না হওয়ায় একপর্যায়ে বৈঠক থেকে বের হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় অনগ্রসর কয়েকটি দেশ ও একাধিক দ্বীপ রাষ্ট্র। নির্ধারিত সময়ের ৩০ ঘণ্টা পর, স্থানীয় সময় শনিবার দিনগত রাত আড়াইটার দিকে নতুন জলবায়ু চুক্তি ঘোষণা করেন কপ টোয়েন্টি নাইন প্রেসিডেন্ট। চুক্তি অনুসারে, জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলার পাশাপাশি সবুজ জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বাড়াতে অনুন্নত দেশগুলোর জন্য বছরে ৩০ হাজার কোটি ডলার বরাদ্দ দিতে সম্মত হয়েছে উন্নত দেশগুলো। ২০৩৫ সাল নাগাদ এই চুক্তি বাস্তবায়নের আশা করছে জাতিসংঘ।
কপ প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণার পর একপক্ষ যখন চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে সম্ভাষণ জানাচ্ছেন, তখন এই চুক্তিকে 'অগ্রহণযোগ্য' হিসেবে উল্লেখ করেছে বেশ কয়েকটি দেশের জলবায়ু প্রতিনিধি। এ তালিকায় যেমন আছে বিশ্বের পঞ্চম অর্থনীতির দেশ ভারত, তেমনি আছে নাইজেরিয়া, পানামা, দক্ষিণ আফ্রিকা ও কিউবার মতো দেশ। বিশেষ করে চুক্তি ঘোষণার আগে আলাদা করে বিবৃতি দিতে চেয়েছিল ভারত। বারবার জানানোর পরেও ভারতকে সে সুযোগ না দেয়ার ক্ষুব্ধ হয়েছেন দেশটির প্রতিনিধি। আর ২০৩৫ সালে ৩০ হাজার কোটি বরাদ্দের ঘোষণাকে হাস্যকর সিদ্ধান্ত বলে মনে করছে নাইজেরিয়া। যদিও চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
ভারত জলবায়ু প্রতিনিধি চাঁদনি রাইনা বলেন, ‘এ ধরনের চুক্তির মূল ভিত্তি হল বিশ্বাস। এই চুক্তি ঘোষণা আগে সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব দেখানো হয়নি। আমাদের মধ্যে যে বিশ্বাসের ঘাটতি আছে সেটিও পরিষ্কার। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব উন্নয়নশীল দেশের ওপরই বেশি পড়ে। যদিও এর জন্য আমরা দায়ি নই।’
নাইজেরিয়ার জলবায়ু প্রতিনিধি এনকিরুকা মাদুয়েকে বলেন, ‘২০৩৫ সাল নাগাদ ৩০০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দের সিদ্ধান্ত উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের জন্য প্রহসন। আমরা এই সিদ্ধান্ত হালকাভাবে নেবো না। এই ঘোষণার পর আনন্দে হাততালি দেয়া কিংবা জোর করে এই অনুদান নেয়ার পক্ষপাতী নই। বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবনা-চিন্তা শুরু করা উচিত।’
সম্মেলনে অংশ নিয়ে, অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি সামলাতে ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি ডলার দাবি করেন। সেখানে এক ধাক্কায় ১ লাখ কোটি ডলার কমানোর সিদ্ধান্ত আসায় অসন্তোষ জানিয়েছেন তারা। আর, অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মাত্র ৩০ হাজার কোটি ডলার দিয়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সম্ভব না। যদিও, পাবলিক ও প্রাইভেট সেক্টরের সহায়তা নিয়ে ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ চেষ্টা করা হবে বলে জানাচ্ছেন কোপ প্রেসিডেন্ট।
এর আগে, ২০০৯ সালে বিশ্বের ধনী দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সামলাতে ১০ হাজার কোটি ডলার বরাদ্দের চুক্তিতে রাজি হয়। ২০২০ সাল নাগাদ এই চুক্তি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা থাকলেও নির্ধারিত সময়ের ২ বছর পর উন্নত দেশগুলো লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে সক্ষম হয়। লোনের পরিবর্তে অনুদান হিসেবে অনুন্নত দেশে যে অর্থ পাঠানো হয়, সেই ঋণশোধ করা জলবায়ুর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার চেয়ে কম কঠিন নয় বলে বারবার জানিয়ে আসছিল অনুন্নত দেশ। নতুন চুক্তিতে অনগ্রসর দেশগুলোর পূর্ববর্তী ঋণ মওকুফ করার আহ্বান জানানো হলেও, এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
গেল দুই সপ্তাহ ধরে জলবায়ু সম্মেলনের সার্থকতা নিয়ে যে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে, নতুন চুক্তির ঘোষণা আসলেও তা পরিষ্কার হয়নি। অনুন্নত দেশের প্রতিনিধিরা মনে করেন, যাদের কারণে জলবায়ু দূষণ বাড়ছে, তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করাই হবে কপ সম্মেলনের উদ্দেশ্য। সেখানে তাদের কাছে হাত পেতে ঋণ নেয়া কোনো সমাধান হতে পারে না বলে দাবি করছেন তারা।