জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বঙ্গোপসাগর ঘেঁষা বাংলাদেশে একদিকে যেমন উজ্জ্বল সূর্য নগর জীবনকে এখন বিষিয়ে তুলছে, অন্যদিকে উপকূলের বাতাস, মেঘ ও তাপের নিম্নমুখী বেগ রোমাঞ্চিত করার বদলে এ অঞ্চলের নদীপাড়ের মানুষের ভাগ্য অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে।
ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, সুপেয় পানির সংকট, বায়ু দূষণ, অতিরিক্ত খরাসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে লড়াই করে বেঁচে আছে দেশের ১৮ কোটি মানুষ। যার সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনে। বিশ্বব্যাংক তথ্য থেকে জানা যায়, ঘূর্ণিঝড়ে বছরে দেশে গড়ে অপচয় হচ্ছে ১ বিলিয়ন ডলার। সংস্থাটির শঙ্কা, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সালে কৃষিখাত থেকে পাওয়া জিডিপি নেমে আসবে ৩ ভাগের এক ভাগে।
কিন্তু বিষয়টিকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছি আমরা? গত এক যুগের বাজেট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১২-১৩ অর্থ বছরে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল ৯৭৩ কোটি টাকা। সে বছর মোট বাজেট ছিল ১ লাখ ৯১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। ১২ বছর পর সেই মন্ত্রণালয়ে বাজেট বেড়েছে মাত্র ৬৫০ কোটি টাকা। হিসাব বলছে, এক যুগে মোট বাজেটের আকার চার গুণ বাড়লেও পরিবেশে বরাদ্দ দ্বিগুণ হারেও বাড়েনি। পরিবেশবিদরা বলছেন, যতটুকু বরাদ্দ হচ্ছে তাও সঠিক কাজে ব্যয় হচ্ছে না।
পরিবেশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, 'বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রজেক্ট দিয়ে আমরা যখন ফুটওভার ব্রিজ করি, আবার যেখানে ফুটওভার ব্রিজ করা দরকার তখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে বাজেট নিতে পারি না। এক্ষেত্রে বাজেটের সঠিক এবং যথেচ্ছা ব্যবহার যেটি নিশ্চিত করা দরকার সেটি হচ্ছে না তার প্রমাণ মেলে। প্রতিবছর যে পরিমাণ মানুষের মৃত্যু হয় তার একটি বড় অংশ পরিবেশ সংশ্লিষ্ট কারণে হয়ে থাকে। এ থেকে বাঁচতে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বাজেট এবং সক্ষমতা বাড়াতে হবে।'
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশকে পাশ কাটিয়ে দেশের টেকসই উন্নয়ন কখনই সম্ভব নয়।
সিপিডি গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, 'মনে রাখা দরকার যে, পরিবেশ মানদণ্ড উত্তীর্ণ হওয়ার মাধ্যমেই কেবল আমরা টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারবো। আমরা যে ২০৪১ সালে উন্নত দেশ দেখতে চাচ্ছি, সেটা যে পরিবেশগত বিপর্যয়ের সম্মুখীন একটা দেশ না হয়। ট্রাস্ট ফান্ডের অনেক প্রকল্পের ব্যাপারেই প্রশ্ন রয়েছে এবং অনিয়ম, দুর্নীতিরও প্রশ্ন রয়েছে।'
পরিবেশ মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী যেন মার্ক টোয়েনের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বললেন, আবহাওয়া নিয়ে গালগপ্প করে সকলেই কিন্তু কাজ করে ক'জন?
তিনি বলেন, 'আমি যদি বায়ু দূষণ নিয়ে বলি, সেখানে আমাদের যোগাযোগ মন্ত্রণালয় বা বিআরটিএর সহযোগিতা দরকার। ডিএমপি, সিটি করপোরেশনের সক্রিয় অংশগ্রহণ দরকার। ঢাকা মহরে কি পরিমাণ বনায়ন আছে, মানমাত্রা আমরা নির্ধারণ করে দিচ্ছি। সেটা অতীতের চেয়ে অনেক কার্যকরভাবে আমরা করছি। পরবর্তী কাজ হচ্ছে সকলকে নিয়ে সেটাকে বাস্তবায়ন করা।'
জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে রক্ষা পেতে আন্তর্জাতিকভাবে সহযোগিতা পেতেও পরিবেশ মন্ত্রণালয় কাজ করছে বলে জানান তিনি।
এবারের পরিবেশ দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হলো খরা, উষ্ণতা, মরুকরণ ও ভূমিধস কমানো। কিন্তু রাজধানীর ঠিক উপকণ্ঠে আমিন বাজারের ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বিশাল ময়লার ভাগাড় একদিকে যেমন বায়ু দূষণ করছে, একই সঙ্গে এই ময়লার ভাগাড়ে সৃষ্ট মিথেন গ্যাস রাজধানীর উষ্ণতা অনেক বেশি বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাই বিভিন্ন দেশি বিদেশি সংস্থা বলছে, এই ধরনের বায়ু দূষণের কারণে একদিকে যেমন রাজধানীবাসীর গড় আয়ু কমছে সাড়ে সাত বছর করে। অন্যদিকে বায়ু দূষণের কারণে মোট জিডিপির ৯ শতাংশই প্রতিবছর অপচয় হচ্ছে।
সেজন্য তারা বলছেন পরিবেশ রক্ষায় একদিকে যেমন বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন, অপরদিকে সরকারিভাবে গড়ে ওঠা বায়ু দূষণমূলক প্রকল্পগুলো অতিসত্বর বন্ধ করে তা বিজ্ঞানসম্মত করা উচিত।