কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সাম্প্রতিক সহিংসতায় শিল্প প্রতিষ্ঠানে হামলার বড় কোনো খবর পাওয়া যায় নি। তাই এ খাত এই অস্থিরতায় কতটা ক্ষতির শিকার হয়েছে তার স্পষ্ট কোনো ছবি নেই। কিন্তু উৎপাদনমুখী শিল্পগুলো ঠিকই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর এর কারণ শুধু অভ্যন্তরীণ বা আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকা নয়, ইন্টারনেট সেবা বিঘ্নিত হওয়াও প্রভাব ফেলেছে এতে।
যেমন, সমতা লেদার কমপ্লেক্স লিমিটেড নামে দেশের চামড়া প্রক্রিয়াজাত একটি কোম্পানি অস্থিরতার মধ্যে ক্রেতাদের সঙ্গে শুধু যোগাযোগ চালিয়ে যেতে না পারায় ২ লাখ ডলারের একটি ক্রয়চুক্তি করতে ব্যর্থ হয়েছে। কোম্পানির পরিচালক একইসঙ্গে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি মো. মিজানুর রহমানের অনুমান, সার্বিকভাবে এ কয়দিনে চামড়া শিল্পের ক্ষতি প্রায় ৩৫ লাখ ডলার।
মো. মিজানুর রহমান বলেন, 'আমরা ইন্টারন্যাশনালি কল করেও কথা বলতে পারিনি। কল গিয়েছে কিন্তু কথা বোঝা যায়নি। এর কারণে আমাদের এ মুহূর্তে যে অর্ডারগুলো ছিল, সেগুলো আমরা কনফার্ম করতে পারিনি। আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ সেগুলো নিয়ে নিয়েছে। আমাদের রপ্তানির যে লক্ষ্যমাত্রা তা বাধার সম্মুখীন হবে।'
শুধু চামড়া শিল্প নয়, চলমান অস্থিরতায় সামগ্রিকভাবে সব ধরনের শিল্পই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে আমদানি-রপ্তানিমুখী শিল্প, রেমিট্যান্সনির্ভর সেবা প্রতিষ্ঠান এবং দেশের প্রতিষ্ঠিত বিদেশি বিনিয়োগ নির্ভর ব্যবসাগুলো। ফিকি'র পর্যবেক্ষণ, নতুন এই পরিস্থিতির কারণে দেশের অর্থনীতিতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের বাজেটের ৮ ভাগের ১ ভাগ। মালয়েশিয়া চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির এই সভাপতি বলছেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে সংশয়ে পড়েছেন।
মালয়েশিয়া চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির বলেন, 'কেউ যখন বিদেশে ইনভেস্ট করে, সে আগে দেখে যে ওই দেশটি রাজনৈতিকভাবে স্টেবল কি না। যদি এ ধরনের পরিস্থিতি হয়, তাহলে যারা বিনিয়োগের চিন্তা করেছে তারাও কিন্তু করতে চায় না আর। আমাদের এই পরিস্থিতি বিনিয়োগকারীদের অনুৎসাহী করে দিয়েছে। বাংলাদেশে কিছু বিপিও কোম্পানি আছে যারা রেজিস্টার্ড হয়তো ইউরোপ বা আমেরিকাতে। কিন্তু, তাদের একটা বড় কাজ বাংলাদেশ থেকে হয় এবং তাদের হেডকোয়ার্টার বাংলাদেশে, ঢাকায়। আমি তিনটি কোম্পানির কথা জানি যারা বাংলাদেশ থেকে তাদের অফিস সরিয়ে নেবে। এমন একে একে অনেকেই সরিয়ে নেবে।'
সংশ্লিষ্টদের কথায় এটা স্পষ্ট, সপ্তাহব্যাপী ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকা কিংবা বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ থাকা বা সাম্প্রতিক অস্থিরতা বিদেশিদের মনে বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুন একটি ধারণা তৈরি করতে পারে। তবে, এটাও তো ঠিক, ভিন্ন একটি দেশে বিনিয়োগ করে ব্যবসা পরিচালনা করার মতো কোনো সিদ্ধান্ত রাতারাতি হয় না। প্রশ্ন হলো, এর আগে বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি কি সন্তোষজনক ছিল?
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ১১ মাসের তথ্যে দেখা গেছে, জুলাই থেকে মে মাস পর্যন্ত আগের অর্থবছরের চেয়ে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ কমেছে বিদেশি বিনিয়োগ। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আংকটাডের প্রতিবেদন অনুসারে, এ প্রবণতা আরও নেতিবাচক। বিশ্ব বিনিয়োগ রিপোর্ট বলছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ১৪ শতাংশ। যদিও ওই বছরে বৈশ্বিক বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ ২ শতাংশ কমেছে বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু যেখানে ২০২২ সালে রেকর্ড ৩৪৮ কোটি ডলার বিনিয়োগ এনে ৪৫টি স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। সেখানে অস্থিতিশীল এই প্রবণতা কেন? বিশেষ করে যেখানে বিশেষ ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল কিংবা দেশে দেশে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিনিয়োগ আকর্ষণের বিভিন্ন কর্মসূচি চলমান আছে?
অর্থনীতিবিদদের মতে, সরকারের নীতি দুর্বলতাসহ এর পেছনে দায়ী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অদক্ষতা।
অর্থনীতিবিদ মাহফুজ কবির বলেন, 'আমরা অবকাঠামোগত উন্নয়ন করছি, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করছি। কিন্তু, আসলে বিনিয়োগকারীরা কী ভাবছেন? আমরা যদি একগুচ্ছ নীতি নিয়ে বসে থাকি। আর তারা আসার পর যদি দেখে যে, এই নীতির কোনো কিছুই বাস্তবায়ন হচ্ছে না তাহলে তারা কিন্তু হতাশ হবেন। অন্য দিক দিয়ে আমাদের প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনামে সবকিছুই সহজ।'
বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদন অনুসারে, বিদেশি বিনিয়োগের নেতিবাচক প্রবণতার মধ্যেই বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী শীর্ষ দেশ নেদারল্যান্ডস। দেশটি ২০২৩ সালের পর বাংলাদেশে প্রায় ৩৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করেছে। এরপর রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন।