মেঘনা ইনস্যুরেন্সের কর্মচারী ইউনুস আলী ব্যাংকে ঘুরছেন পাঁচটি চেক নিয়ে। অফিসের স্বাভাবিক কাজকর্ম চালানোও এখন কঠিন হয়ে পড়েছে ব্যাংক থেকে পর্যাপ্ত টাকা তুলতে না পারায়।
ইউনুস আলী বলেন, 'আমাদের কোম্পানির টাকা দরকার। কারণ আমাদের এজেন্টের টাকা জমা দিয়ে আবার সাথে সাথে সেই টাকাটা তুলতে হয়। এখন আমি টাকা জমা দিতে পারছি কিন্তু তুলতে পারছি না। বড়ধরনের কোনো কাজই করতে পারছি না। সবকিছুই আটকে আছে।'
মাসের শুরুতে বেতন হয়েছে, সেটা খুশির খবর। কিন্তু এক বুথ থেকে আরেক বুথে ঘুরছেন গার্মেন্টস অ্যাক্সেসরিজ একটি কোম্পানিতে চাকরি করা রিপন। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামি ব্যাংকের কার্ডটি এখন অন্য ব্যাংকের বুথেও অগ্রহণযোগ্য।
রিপন বলেন, 'আমার কাজ হচ্ছে উত্তরা। উত্তরা থেকে এই মতিঝিল আসছি। উত্তরার বুথগুলোও বন্ধ। টাকা তো এখন তুলতে পালি না। ভবিষ্যতে কী হবে সেটাও বুঝতে পারছি না।'
একই অবস্থা আরও অনেকের। ভাগ্য কিছুটা ভালো হলে কেউ কেউ চাহিদার তুলনায় কম টাকা তুলে নিতে পারছেন। ব্যক্তিগত বাদ দিলে, অন্তত তিন হাজার বাণিজ্যিক ও কর্পোরেট ব্যাংক হিসাব এখন ইসলামি ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকটের কারণে স্থবির। তার ওপর নয় ব্যাংকের ড্রাফট গ্রহণে বন্দরের বিধি নিষেধে বাণিজ্যিক কার্যক্রম এখন অনিশ্চয়তা আরো তুঙ্গে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু বলেন, 'আমার হয়তো ওই আট বা নয় ব্যাংক ছাড়া আর কোনো ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট নেই। আমার কী হবে? আমি তাহলে কী করবো? শিপিং এজেন্টরা তো বন্দরের আগেই বন্ধ তরে দিয়েছে। এতে কাজের সময় বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, আজকের পণ্য অনেক ক্ষেত্রে আজকে ডেলিভারি নিতে পারছি না, পরের দিন যাচ্ছে। এতে ডেমারেজ বাড়ছে।'
এই পরিস্থিতি দীর্ঘদিনের সুশাসনের অভাবে হয়েছে। তার সাথে সরকারের শেষ দিকে স্বেচ্ছাচারিতায় আরও বেড়েছে সংকট। অর্থবছরের শুরুতে দেশের রিজার্ভের ঘর পাকা দেখাতে ইসলামি ব্যাংক থেকে সমপরিমাণ টাকার বিনিময়ে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ৫৫০ মিলিয়ন ডলার কেনে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর বিপরীতে এস আলমের ইসলামি ব্যাংককে সমপরিমাণ অর্থ দেয় আবদুর রাউফ তালুকদার, সাবেক ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান ও গভর্নরের উপদেষ্টা আবু ফারাহ মো. নাসের।
পরবর্তীতে ব্যাংকটি ১০০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করে। তবে, বকেয়া ডাবল এন্ট্রি সিস্টেম সমন্বয় করা হলে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার কমে রিজার্ভের ঘর থেকে। ব্যাংক বিশ্লেষকরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে রাজনীতিকীকরণের কারণে রিজার্ভের অবৈধ কাটছাট-অনিয়ম বৈধতা পেয়েছে বিগত সরকারের আমলে। সরকারের মসনদ মজবুত রাখার সংস্থা হয়ে উঠেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশিদ বলেন, 'হাজার হাজার কোটি টাকা দেয়ার পরও কি আমাদের লাভ হয়েছে? আমরা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা নিয়ে ফরমার্স ব্যাংকে টাকা দিয়েছিলাম। সেখানে কি লাভ হয়েছে? সেজন্য এই সমস্ত বস্তাপচা মান্ধাতা আমলের প্র্যাক্টিস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পলিটিক্যালি ফিক্স না করে ইকোনোমিকে ফিক্স করা যায় না। কারা গভর্নর হবে, কারা ডেপুটি গভর্নর হবে সেখানে আজকে যদি সুশাসন, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা আমরা না আনতে পারি তাহলে তারা প্রত্যেকে ফেইল করবে। বাংলাদেশ ব্যাংক আর একটা অর্থ মন্ত্রণালয় না।'
এদিকে ব্যাংক ব্যবস্থাপনার এই অনিশ্চয়তায় অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, সামনে কঠোর সময় আসছে। দীর্ঘমেয়াদি এই তারল্য সংকট চললে প্রভাব পড়বে জরুরি আমদানি রপ্তানি খাতেও।
অর্থনীতিবিদ মাহফুজ কবির বলেন, 'শিল্প থেকে শুরু করে আমদানি-রপ্তানির প্রতিটি কথা মাথায় রেখে, যে সমস্ত ব্যবসায়ীরা এসব ব্যাংকের গ্রাহক তাদের কথা মাথায় রাখতে হবে। তারা কিন্তু সংখ্যায় কম না। পুরো অর্থনীতিতে তাদের বড় একটা কন্ট্রিবিউশন রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটা বড় দায়িত্ব বন্দর কর্তৃপক্ষকে বলে দেয়া যে, এই ব্যাংকগুলোকে উদ্ধারের প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেজন্য তাদের সহায়তা করা হোক। বন্দরের দেখাদেখি সরকারি-বেসরকারি আরও অনেক প্রতিষ্ঠান কিন্তু তাদের চেক গ্রহণ করবে না। তাতে লেনদেন বন্ধ করে রাখা হলে, সেক্ষেত্রে এই ব্যাংকগুলো আর উঠে দাঁড়াতেই পারবে না।'
এদিকে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে অর্থ দিতে গেলে অন্য ব্যাংকগুলোও পড়বে তারল্য ঝুঁকিতে। দুই লাখ কোটি টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছাড়া হলে বাড়বে মূল্যস্ফিতি। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের লাভের অংশ থেকে এই সহায়তা করা হবে কিনা সেটিও ভেবে দেখার কথা জানান অর্থনীতিবিদরা।