প্রবাস
অর্থনীতি
0

দেশের বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাতে রেকর্ড

সর্বকালের সেরা রেকর্ড দেশের বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাতে। অতীতের সব পরিসংখ্যান ছাড়িয়ে চলতি বছরের এগারো মাসেই ১২ লাখের বেশী কর্মী প্রবাসে পাড়ি জমিয়েছেন কাজের খোঁজে। যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় দেড় লাখ বেশি।

ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরের যাত্রী পরিবহনের যে জৌলুস তার সিংহভাগই প্রবাসগামী কর্মী। সম্প্রতি প্রত্যেক বছর গড়ে লাখ ছাড়াচ্ছে প্রবাসে পাড়ি জমানো কর্মী। তবে চলতি বছর অতীতের সব হিসেবকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে তারা। এগারো মাসেই ভেঙে দিয়েছে অতীতের সব রেকর্ড।

এ বছর নভেম্বর পর্যন্ত কাজ নিয়ে বিশ্ববাজারে ছড়িয়ে পড়া কর্মীর সংখ্যা ১২ লাখ ১০ হাজার ছাড়িয়েছে। কর্মীদের শীর্ষ গন্তব্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব, ওমান আর পূবের দেশ মালয়েশিয়া। মোট কর্মীর অর্ধেক ঘাম ঝরাচ্ছেন এই তিন দেশে। তবে আসছে বছর মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে ইউরোপ কিংবা নর্থ আমেরিকায় বিকল্প শ্রমবাজার সৃষ্টির স্বপ্ন বুনছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি, বায়রা'র মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, 'সৌদি আরবের মতো দেশ যেখানে মেগাসিটিগুলো হচ্ছে। ২০৩৪ ফুটবল কাপকে তারা আশা করে এবং সেটাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্টেডিয়ামের কাজ হচ্ছে। সুতরাং বড় চাহিদা সেখানেও আছে। তবে স্কিল, সেমি স্কিলের রিকয়ারমেন্ট সেখানে থেকে যাচ্ছে।'

জনশক্তি রপ্তানিকারক, রুহুল আমিন স্বপন বলেন, 'আমার বিশ্বাস আমরা এখন আর মধ্যপ্রাচ্যে থাকবো না। এটি শুধু ইউরোপেও থাকবে না। এটি নর্থ আমেরিকায়ও থাকবে। এই রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়া বেশি সংখ্যার চেয়ে স্কিল ও জিরো কস্টের দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।'

এদিকে বরাবরের মত দেশের দক্ষিণের জেলাগুলো বৈদেশিক কর্মসংস্থানে এগিয়ে থাকে। এ বছরও তার ব্যাত্যয় হয়নি। কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর এবার থেকে কর্মী যাবার সংখ্য বেড়েছে লাফিয়ে। পাঁচ জেলা থেকেই প্রবাসী হয়েছেন অন্তত চার লাখ।

এভাবেই গেল ১৪ বছরে বাংলাদেশ থেকে নব্বই লাখেরও বেশি মানুষ কাজ নিয়ে দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছেন যাদের বয়স ১৮ থেকে ৩০ কিংবা ৩৫ বছর। এর মাধ্যমে বিশ্ববাজারে যেমন বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বেড়েছে একইসঙ্গে বেড়েছে প্রবাসী আয়ও। কিন্তু বাংলাদেশ হারিয়েছে দক্ষ এবং কর্মঠ তরুণ জনশক্তি। যারা কিনা দেশে থাকলে দেশের অর্থনীতিতে যেমন অবদান রাখতে পারতেন, একইসঙ্গে থাকতে পারতেন নিজ পরিবারের কাছে। এমন বাস্তবতায় শ্রমবাজার শুধু সংখ্যায় না বাড়িয়ে দেশেই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার তাগিদ অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের।

কিন্তু যে অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য স্বজন রেখে এই প্রবাস যাত্রার প্রবনতা তার কতখানি পূরণ হচ্ছে? ঘুরপাক খাচ্ছে এমন প্রশ্ন। একদিকে অদক্ষ কর্মীর স্বল্প বেতন অন্যদিকে উচ্চ অভিবাসন খরচ। তারপরও কী কারণে বিদেশমুখী হতে এত উন্মুখ দেশের কর্মঠ জনগোষ্ঠী? শুধুই কি উচ্চ আয়ের স্বপ্ন নাকি দেশে কর্মসংস্থানের সংকুচিত সুযোগ!

অর্থনীতি বিশ্লেষক আল আমিন বলেন, 'রাষ্ট্র একজন প্রবাসী কর্মীকে মনে করছে টাকা উৎপাদনের মেশিন। এর বাইরে ওই ব্যক্তির যে সামাজিক সম্পর্ক, ওই ব্যক্তির যে ব্যক্তিগত বিষয়গুলো, পরিবারের সাথে তার যে সংযোগ বা যোগাযোগ অথবা প্রবাস জীবন শেষ করে দেশে ফিরে আসার পরে তার যে একটা নিরাপদ অথবা এক ধরনের প্রত্যাশিত জীবন অথবা অধিকারবোধ সম্পন্ন জীবনের যে নিশ্চয়তা সে ব্যবস্থাগুলো আমরা করতে পারি নাই। এখান থেকে হয়তো আমরা অর্থের মুখ দেখবো, কিন্তু সামগ্রিকভাবে আমরা লাভবান হবো না।'

সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, একদিকে দেশে কর্মসংস্থানের অবারিত সুযোগ না থাকায় তারুণ্যে ভর করছে হতাশা। সংকট কাটাতে বিদেশে গিয়েও পারিবারিক জীবন ব্যবস্থাপনার শৃঙ্খলায় ঘাটতি থাকছে অনেকের। এমন বাস্তবতায় রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উদ্যোগও জরুরি বলে মনে করছেন তারা।

আরেক অর্থনীতি বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, 'একটা লোক দেশের বাইরে গিয়ে ড্রাইভিং করছে, কিন্তু দেশের ভিতরে সে ড্রাইভিং করবে না। দেশের বাইরে হয়তো রেস্টুরেন্ট কিংবা আরও অনেক জায়গায় কাজ করছে, সেই কাজটা যদি তারা দেশেই করতো তাহলে দেশে একটা কর্মসংস্থান তৈরি হতো। তারাও অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারতো। তরুণ সমাজ দেখছে আমি যে কাজটা করবো সেটা আমার সোসাইটি কীভাবে নিবে।'

তবে বৈদেশিক কর্মসংস্থানে রেকর্ড হলেও সে হারে বাড়ছে না প্রবাসী আয়। এমন বাস্তবতায় শ্রমজাবার সংখ্যায় না বাড়িয়ে কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নে জোর দেবার পরামর্শ খাত বিশেষজ্ঞদের।

এসএসএস