অপরাধ ও আদালত
0

জুলাই গণহত্যার বিচারে আইন সংশোধনের সুপারিশ, গুরুত্ব পাবে ভিডিও ফুটেজ আলামত

জুলাই গণহত্যার বিচার নিয়ে যেন কোনো বিতর্ক তৈরি না হয় সেজন্য আইন সংশোধনের সুপারিশ আন্তর্জাতিক আইনজ্ঞদের। তারা বলছেন, বিচারের প্রতিটি প্রক্রিয়ায় যাতে অপরাধীর আত্মপক্ষ সমর্থনের অবারিত সুযোগের সঙ্গে ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ ও সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখা হবে জানিয়ে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর জানান, ভিডিও ফুটেজের মতো ডিজিটাল আলামত গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য হিসেবে গুরুত্ব পাবে। ১৯৭৩ সালের আইন দিয়ে ২০২৪ সালের বিচার বিতর্কে তিনি আরও জানান, বিদ্যমান আইনে এ বিচার করতে বাঁধা নেই।

২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থান দমনে চালানো নিপীড়ন, হত্যাযজ্ঞের বিচার করার দায়িত্ব পড়ছে এই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ওপর।

পুরাতন হাইকোর্ট ভবনটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মূল ভবন হিসেবেই বেশি পরিচিত, সেখানে দেখা যাচ্ছে সংস্কারের কর্মযজ্ঞ। ভেতরে বিচারকদের খাস কামড়া প্রস্তুত আছে। সংস্কার হচ্ছে আসামিদের গারদ ও বিচার কাজ সম্পন্ন করার এজলাস।

প্রসিকিউশন টিমের নিয়োগ আগেই হয়েছিল, অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তিন বিচারক নিয়োগের পর ৫ আগস্টের পর আজ (বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর) আবার নতুনভাবে শুরু হচ্ছে এই ট্রাইব্যুনালের কাজ। ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলিরা বলছেন, এখন পর্যন্ত তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন অফিসে অভিযোগ জমা পড়েছে ৬০টির মত। বিচার কাজ শুরু করতে যেগুলো থেকে চার্জ ফ্রেমিংয়ের কাজ করছে রাষ্ট্রের আইনজীবীরা।

১৯৭১ এ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্তদের বিচার এই ট্রাইব্যুনালে হয়েছে। যেই বিচারের নানা বিষয় নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন তুলেছে জাতিসংঘসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা। এখন যখন জুলাই গণহত্যার বিচারের জন্য সেই একই ট্রাইব্যুনালের ওপর আস্থা রাখতে চায় সরকার, তখন আবারও প্রশ্ন উঠেছে, পুরোনো এই আইন দিয়ে বিতর্কমুক্ত বিচার কতটা সম্ভব? বিশেষকরে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার জন্য যে আইন, সেটা দিয়ে ২৪ সালের।

সেই ট্রাইবুনালের আইনজীবী এখন ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মো. তাজুল ইসলাম। তার কাছে এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চায় এখন টিভি।

আইসিটির চিফ প্রসিকিউটর মো. তাজুল ইসলাম বলেন, 'অতীতে যেটা হয়েছে যে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার ক্ষমতা আপনার ছিল, সেটা ব্যবহার করেননি, অপব্যবহার করেছেন। ট্রাইব্যুনালেই শুধু অবিচার হয়েছে তা তো নয়। অতীতে সুপ্রিম কোর্ট ছিল, আমাদের এই ট্রাইব্যুনালের উপরে আপিলেট আদালত হচ্ছে সুপ্রিম কোর্ট। এখানে যে সমস্ত জাজমেন্ট হয়েছে সেগুলো কনফার্ম হয়েছে সুপ্রিম কোর্ট থেকে। ১৯৭৪ সালের আইন দিয়ে অবশ্যই ২০২৪ এর বিচার করা যাবে। ফৌজদারি কার্যবিধির যে আইন আছে সিআরপিসি, এটা ১৯০৮ সারের আইন। সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ সালের। আইন পুরাতন হলে তো কোনো সমস্যা নেই। আমাদের ১৯৭৪ সালের ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্টে বলাই আছে ৭৪ সালের আইন প্রণয়ের আগে বা পরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যেকোনো জায়গায় যদি এই আইনের অপরাধ সংগঠিত হয় তাহলে সেই বিচার করার ক্ষমতা ট্রাইব্যুনালের থাকবে।'

১৯৭৩ সালের দ্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট ১৯৭৩ এর ২৬টি ধারার ৩ নম্বর জুরিসডিকশন অব ট্রাইব্যুনাল এন্ড ক্রাইমস ধারায় আন্তর্জাতিক অপরাধের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। যেমন ৩ এর ২ এর ক-তে বলা হয়েছে: 'হত্যা, নিশ্চিহ্ন করণ, দাসকরণ, নির্বাসিত করণ, কারারুদ্ধ করণ, অপহরণ, অবরোধ করণ, নির্যাতন, ধর্ষণ অথবা বেসামরিক নাগরিকদের উপর অন্যান্য অমানবিক কাজ পরিচালনা করা অথবা সংগঠিত হওয়ার স্থানে অভ্যন্তরীণ আইন ভঙ্গ করে বা না করে রাজনৈতিক, গোত্রগত, জাতিগত অথবা ধর্মীয় কারণে নিপীড়ন করা, মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।'

যেগুলোর সঙ্গে ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের নির্যাতনের মিল রয়েছে বলে মনে করেন আইনজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব দিক বিবেচনা করলে আইনটি বিচারকাজ সম্পন্ন করতে যথেষ্ট শক্তিশালী, কিন্তু আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিশ্চিতে আরও কিছু বিষয়ের ঘাটতি আছে।

আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ কাজী ওমর ফয়সাল বলেন, 'আন্তর্জাতিক ক্রাইম যেগুলো হয়, সেগুলোর বিচারের ক্ষেত্রে আপনি যতবেশি ডিফেন্স রাইট প্রোভাইড করতে পারবেন, তার লেজিটিমেসি ততটুকু বেশি হবে। আগে ট্রাইব্যুনালের বিচারগুলোর শাস্তি কী ছিল? শুধু মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবৎজীবন কারাদণ্ড। এটার কিন্তু আরও অনেক ধরনের শাস্তি আছে। যারা এখন সাক্ষী হবেন তাদের ভবিষ্যৎ প্রটেকশন কী হবে? এরাও কী আবার পরে কোনো হয়রানির শিকার হবেন কী না? সবকিছু খেয়াল রাখতে হবে।'

চিফ প্রসিকিউটর মো. তাজুল ইসলাম বলেন, 'আইসিসি রুলস অফ প্রসিডিউরে যে ধারণাগুলো আছে সেটার ভিত্তিতেই কিন্তু এটার রুলস ফ্রেম করা হয়েছে। সেই স্ট্যান্ডার্ড আমরা মেইন্টেন করার চেষ্টা করবো। কিন্তু আইসিসির অধীনে যে কোর্ট, তাদের বিচারিক প্রক্রিয়া আর আমাদের বিচারিক প্রক্রিয়া তো এক নয়।'

বাস্তবতা হলো, এই আইনের সংশোধন নিয়ে এরই মধ্যে সরকার কাজ শুরু করেছে। এবং অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য বিদেশ থেকে আইনজীবী নিয়োগেরও সুযোগ রাখা হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আগে আইনের সংশোধন না আগে বিচার কাজ শুরু করা?

ওমর ফয়সাল বলেন, 'এই অ্যামেনমেন্টটা বিচারকার্য শুরু করার আগে করা উচিত। যেন অ্যাকিউজড জানতে পারে যে আমার ওপর এই অভিযোগগুলো আনা হয়েছে। এবং আমার এই অধিকার আছে। ১৯৭৩ বা ১৯৭১ সালের প্রেক্ষাপটে হয়তো ওইটা ঠিক ছিল। কারণ যুদ্ধের সময় ওতগুলো প্রমাণ সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু এখন যে পরিমাণ ভিডিও আছে, প্রমাণ আছে সেক্ষেত্রে এটা খুবই সহজ যে টেকনিক্যাল রুলস ব্যবহার করে এগুলোকে বিচার করার।'

মো. তাজুল ইসলাম বলেন, 'সংশোধনীর যে সমস্ত প্রস্তাব আছে সেজন্য এখন যে প্রক্রিয়াগুলো শুরু হচ্ছে এগুলো কোনোভাবে প্রভাবিত হবে না। সেটা হচ্ছে যখন বিচারপর্ব শুরু হবে সেখানে যে অ্যামেনমেন্টগুলো প্রপোজ করা হয়েছে সেটা বিচারপর্বে দরকার হবে। আইনে একদম ওয়াইড ক্ষমতা দেয়া আছে। সুতরাং এই মামলায় ২০২৪ এ যে বিচার হতে যাচ্ছে সেটার একটা মূল উপাদান হবে ডিজিটাল প্রমাণ। সেটা গ্রহণ করার অধিকার এই ট্রাইব্যুনালকে দেয়া হয়েছে।'

দুই এক বছরের মতো একটা দ্রুততম সময় নিয়ে বিতর্কমুক্ত একটা বিচারকাজ সম্পন্ন করতে বেশ আশাবাদী আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নতুন নিয়োগ পাওয়া প্রসিকিউশন টিম। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে সাক্ষীদের নিরাপত্তা, ভুক্তভোগী ক্ষতিপূরণ দেবার মত আইনের যেসব সংশোধনীর কথা বলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিতে তার কতটা হয়, সেটি বোঝা যাবে এই আইনটির সংশোধন হয়ে, অধ্যাদেশ জারির পর।

এসএস

এই সম্পর্কিত অন্যান্য খবর