শিক্ষা , বাজেট ভাবনা
বাজেট ২০২৪-২৫

বাজেটের অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহারের সক্ষমতায় নজর শিক্ষামন্ত্রীর

গত এক দশকে শিক্ষা অবকাঠামোর অগ্রগতি হলেও এখনও অনেক প্রতিষ্ঠানে জরাজীর্ণ শ্রেণিকক্ষে চলে পাঠদান কার্যক্রম। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে যে পরিবেশ ও সক্ষমতা দরকার তার কিছুই নেই। টেকসই, আধুনিক, পরিবেশবান্ধব ও দৃষ্টিনন্দন শিক্ষা অবকাঠামো নির্মাণ এখন জরুরি। এ জন্য বরাদ্দ বাড়ানোর কথা বলছে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর। অন্যদিকে আগামী অর্থবছরে বরাদ্দের পুরো অর্থকে খরচের সক্ষমতা অর্জনের দিকে এবার নজর দেয়ার কথা বলছেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী ।

গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বড়ইবাড়ী আলহাজ্ব কছিম উদ্দিন ইনস্টিটিউটে মরিচা ধরে ঘরের টিন নষ্ট প্রায়, নষ্ট হয়েছে দরজা-জানালাও। প্রতিষ্ঠানের ঘুণে ধরা বেঞ্চ যেন ব্যবহার অনুপযোগী, বিদ্যুতের বাল্বের ভাঙা হোল্ডার যে কত আগের, বাল্ব লাগানোর অবস্থায় নেই। মাথার ওপরে টিনের চালেরও বেহাল দশা। ভাঙা হোয়াইট বোর্ডেই লেখার চেষ্টা করে যান শিক্ষকরা।

গত এক দশকে শিক্ষার অবকাঠামো উন্নয়নে গ্রাম এবং শহরের বৈষম্য অনেকটা কমে আসলেও এখনও প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক প্রতিষ্ঠানের অবস্থাই জরাজীর্ণ। নতুন শিক্ষাক্রমে হাতে কলমে বাস্তবে করে শেখার যে পরিবেশ প্রয়োজন তার অভাব আলহাজ্ব কছিম উদ্দিন ইনস্টিটিউটে একেবারে স্পষ্ট। অবকাঠামো সক্ষমতার অভাবে শ্রেণি কাঠামো ব্যাহত হওয়ার কথা বললেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।

ভাঙ্গা বোর্ডে লিখে ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষক। ছবি: এখন টিভি

একজন শিক্ষার্থী বলেন, 'আমাদের ক্লাস করতে অনেক অসুবিধা হয়। সূর্যের আলো টিনের ওপর পড়লে সে তাপ আমাদের শরীরে লাগে। ক্লাসরুমগুলোতে পর্যাপ্ত লাইট নেই। বৃষ্টির সময় এখানে ক্লাস করতে বেশি অসুবিধা হয়।

প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সুশীল চন্দ্র সরকার বলেন, 'নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন করতে গেলে আধুনিক শিক্ষার জন্য যে উপকরণ প্রয়োজন এবং ক্লাসরুমের যে সুন্দর একটা পরিবেশ থাকা প্রয়োজন সে পরিবেশ এখানে নেই।'

গত দেড় দশকে শুধু শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরই ৫০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪১টি প্রকল্পের মাধ্যমে সারাদেশে প্রায় ২২ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ভবন নির্মাণ করা করেছে। চলতি অর্থ বছরেও ১ হাজার ১৮৪ কোটি ২১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয় এই অধিদপ্তরকে। তবে ব্যয়ের তুলনায় কতটা মান রক্ষা হয় অবকাঠামোয়? সম্প্রতি এক কর্মশালায় খোদ শিক্ষাসচিব সোলেমান খান ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, 'যে টাকা দিয়ে অবকাঠামো ও ফার্নিচার তৈরি করা হয় সেটা সর্বোচ্চমানের বিল্ডিং ও সর্বোচ্চমানের আসবাব হওয়া উচিত। কিন্তু যখন আমরা দেখতে যাই তখন আমরা সেই মানের পাই না।'

তবে এ অভিযোগ পুরোপুরি মানতে নারাজ শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. দেলোয়ার হোসেন মজুমদার। তিনি জানান, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে টেকসই, আধুনিক, পরিবেশবান্ধব ও দৃষ্টিনন্দন শিক্ষা অবকাঠামো নির্মাণ জরুরি। এ জন্য এতে বাড়াতে হবে বরাদ্দও।

জরাজীর্ণ পুরান ভবনে চলে শিক্ষা কার্যক্রম। ছবি: এখন টিভি

মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন বলেন, 'ফার্নিচারের ডিজাইন কীভাবে করতে হবে এবং ভবনগুলোকে কীভাবে রূপায়িত করলে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের সুবিধা হবে? ভবিষ্যতে যে ভবনগুলো আমরা তৈরি করবো সেগুলোতে ডিজাইনের কি পরিবর্তন আনতে হবে বিষয়গুলো থেকে আমরা সে সিদ্ধান্ত নিতে পারবো।'

জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে সম্ভাব্য ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ পাবে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর। সবমিলিয়ে এডিপিতে শিক্ষাখাতে কিছুটা বাড়িয়ে এবারের সম্ভাব্য বরাদ্দ ৩১ হাজার ৫২৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা। যেখানে পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয় মিলিয়ে সম্ভাব্য বরাদ্দ প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা।

দেশে প্রতিবছর টাকার অঙ্কে শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় কিংবা জিডিপির হারে বাড়েনি। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশই বাংলাদেশের চেয়ে জিডিপির হারে বাজেট বেশি দেয়। এমনকি শিক্ষায় জিডিপির হারে বিশ্বের সবচেয়ে কম বরাদ্দ পাওয়া ১০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশও।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, এ খাতে মোট বাজেটের ২০ শতাংশ এবং জিডিপির হারে অন্তত ৬ শতাংশ বরাদ্দ দেয়ার লক্ষ্য অর্জনে সরকারকে পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে।

শিক্ষা বিশ্লেষক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'সরকার প্রতিবছর বলছে শিক্ষা আমাদের সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার। কিন্তু বাজেটের সাথে যখন বরাদ্দ হয় সেটির প্রতিফলনে আমরা সমন্বয়ের ব্যাপক ঘাটতি দেখি। লক্ষ্যে পৌঁছাতে একটি রোডম্যাপ থাকতে হবে। কিন্তু আমরা সেটি দেখছি না।'

প্রতিবছর শিক্ষাখাতে যা বরাদ্দ বরাদ্দ হয় তার পুরোটা খরচ করতে পারে না সরকার। বড় একটা অংশ ফেরত যায়। শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলছেন, বাজেট কেবল বাড়ালে হবে না, পুরো অর্থকে সঠিকভাবে ব্যবহার করার সক্ষমতার দিকে এবার নজর থাকবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের।

তিনি বলেন, 'একটা আলোচনা হয় যে, অনেক বেশি বাজেট দিলে হয়তো শিক্ষা রাতারাতি পরিবর্তন হবে। এখন বাজেট শুধু বাড়লে হবে না, প্রতিষ্ঠানের যে সক্ষমতা সেটাও বাড়তে হবে। অর্থটাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করার সক্ষমতাও গুরুত্বপূর্ণ।'

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে যে সব সক্ষমতার অভাব রয়েছে, আগামী বাজেটে সে দিকে নজর দেয়ার তাগিদ শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের।

এমএসআরএস

এই সম্পর্কিত অন্যান্য খবর