হাওরাঞ্চলে চলছে ধান কাটার ধুম, ইতোমধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ ধান ঘরে তুলতে পেরেছেন কৃষকরা। বাকি যে টুকু আছে তা আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে আগামী ৮-১০ দিনের মধ্যেই ঘরে তুলা সম্ভব বলছে কৃষি অধিদপ্তর। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে ধানের প্রকৃত বা ন্যায্য মূল্য নিয়ে। প্রতিবছর সরকার ধানের যে দাম নির্ধারণ করে তার তুলনায় অনেক কম দামে বিক্রি করতে হয় কৃষকদের।
সুনামগঞ্জ সদরের বাহাদুরপুর গ্রামের কৃষক ছালিম উদ্দিন। ১২ বিঘা জমি থেকে ধান সংগ্রহে ব্যস্ত এখন। কিন্তু নগদ অর্থের প্রয়োজনে এরইমধ্যে সংগ্রহ করা ধানের কিছু অংশ বিক্রি করতে হচ্ছে তার। তবে উৎপাদন খরচ অনুপাতে বিক্রি করতে পারেননি।
ছালিম উদ্দিন বলেন, 'সরকারের যে ধানের দর সেটাতেও বিক্রি করতে পারি না সিন্ডিকেটের কারণে। ৮৫০-৯০০ টাকা সবোর্চ্চ বিক্রি করা যায়। যার কারণে আমরা লাভবান হইতে পারি না।'
তার মতো হাওরাঞ্চলের সব কৃষকের অভিজ্ঞতা একই রকম। কোনবারই বেঁধে দেয়া দরে ধানের দাম পান না তারা। বরং মধ্যসত্বভোগী ব্যবসায়ী বা ফড়িয়ারা যে দাম নির্ধারণ করেন, সেই দামেই বিক্রি করতে বাধ্য হন কৃষকরা।
কৃষক বলেন, কার্তিক মাস থেকে বৈশাখ পর্যন্ত আমরা যে হার ভাঙ্গা পরিশ্রম করি সেই অনুপাতে লাভবান হইতে পারি না।
কৃষিবিদরা বলছেন, বিগত বছরের তুলনায় এবার প্রান্তিক কৃষকের উৎপাদন খরচ অনেক বেশি। বিশেষ করে বীজ, সার, সেচসহ শ্রম, মজুরি, রোগবালাই ব্যবস্থাপনা এবং মুলধন প্রেক্ষাপটে বিঘাপ্রতি নীট খরচ কমপক্ষে ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা। এতে উৎপাদিত ধানের গড় খরচ কেজিপ্রতি ৩০ টাকারও বেশি। সেক্ষেত্রে ৩২ টাকা দামে কৃষক লাভবান হওয়ার সুযোগ খুবই কম।
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থসংস্থান ও ব্যাংকিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শাহ আলমগীর বলেন, 'কৃষকের ১ কেজি ধান উৎপাদন করতে গিয়ে খরচ হয়ে যাচ্ছে ৩১ টাকার মতো। সেখানে ৩২-৩৪ টাকায় বিক্রি করলে কি লাভবান হওয়া সম্ভব? আমরা শুধু ধানের ফলনটা দেখছি। কিন্তু এখানে কৃষকের পরিবারের অন্য সদস্যরাও কাজ করে। এ শ্রমিক মজুরির কথা আমরা ভাবছি না। যদি এটা যোগ করা যায় তাহলে ধানের মূল্য আরও বেশি হওয়ার কথা।'
এবার হাওরাঞ্চলে যে উৎপাদন হয়েছে তা লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি। ইতোমধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ধান কাটা হয়ে গেছে। সেই ধানের ন্যায্য দাম নিশ্চিতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলছেন সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম।
তিনি বলেন, 'আমরা আশা করছি মে মাসের ৫ তারিখের মধ্যে হাওরের শতভাগ ধান কাটা হয়ে যাবে। এখন পর্যন্ত আমাদের কোন শ্রমিক সংকট নেই। বিভিন্ন উপজেলায় ৮০০ এর উপরে সরকারি কম্বাইন হার্ভেস্টার এবং জেলার বাইরে থেকে প্রায় ২০০ হার্ভেস্টার আসছে।'
প্রতিবছর হাওরাঞ্চলে যে পরিমাণ ধান উৎপাদন হয় তারমধ্যে নামমাত্র অংশ সরকারিভাবে সংগ্রহ করা হয়, যার কারণে অধিকাংশ ধান কৃষকদের বিক্রি করতে হয় মধ্যসত্বভোগীদের কাছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার যদি হাওরাঞ্চলে ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা আরও বাড়িয়ে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করে, তবেই বাজার ব্যবস্থায় ভারসাম্য আসবে।
অধ্যাপক ড. মো. শাহ আলমগীর আরও বলেন, 'কৃষক থেকে ভোক্তা ধান আসা পর্যন্ত মাঝখানে অনেকেই কাজ করছে। এটাই হচ্ছে মূল সমস্যা। এটাকে বাজার ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসতে পারলে কৃষকরা সঠিক দাম পাবে।'
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সিলেট বিভাগের ৪ জেলায় এবার বোরো আবাদ হয়েছে ৪ লাখ ৯২ হাজার ৯৭০ হেক্টর। যা থেকে উৎপাদিত চালের লক্ষ্যমাত্রা ২০ লাখ ২২ হাজার ৯৮১ টন, যা গতবারের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি।