কর্মীর শ্রমেই প্রাণ পায় দেশের অর্থনীতি। পরিবার থেকে রাষ্ট্রের চাকা চলতে থাকে, জিডিপিও বাড়ে। আর তাতে এখন ২১ শতাংশের যোগান দিচ্ছেন নারীরা। শীর্ষ রপ্তানি খাত পোশাকের সিংহভাগও এগিয়ে যাচ্ছে তাদের হাত ধরেই।
লিড সনদপ্রপ্ত সাভারের 'ফোরএ ইয়ার্ন ডাইং' সবুজ কারখানার ৭ হাজার ৪০ জন শ্রমিকের ৭২ ভাগই নারী। ভিতরের তাদের কর্মযজ্ঞই সাক্ষ্য দিচ্ছে পোশাক খাতে নারীর অবদানের। শুধু কি সাধারণ শ্রমিক হিসেবে? কয়েক দশক ধরে এ খাতের নারীরা এগিয়েছেন বহুদূর।
কারখানাটির ৬ষ্ঠ তলার অধিকাংশ লাইনেই উৎপাদন হয় জ্যাকেট। পুরোপুরি উৎপাদনে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো পরিমাপ দেখে নেন সিনিয়র টেকনিশিয়ান রিফাত শেখ। তবে হঠাৎ গড়মিলে উপায় না পেয়ে ডাকেন ঊর্দ্ধতনকে।
ক্রেতার নির্দ্দিষ্ট ডিজাইনে উৎপাদনের পর এই জ্যাকেটের গন্তব্য হবে ইউরোপের দেশ সুইডেন। টেকনিশিয়ান ম্যানেজার সাথী আকতার রেনু হাতেকলমে বুঝিয়ে দেন সঠিক পরিমাপ।
অন্যদের কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছেন সাথী আকতার রেনু। ছবি: এখন টিভি
মাত্র ১ হাজার ৬০০ টাকা বেতনে গার্মেন্টেসের সুইং হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করা রেনু এখন টেকনিশিয়ান ম্যানেজার। মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোতে না পারলেও এগিয়েছেন অনেক দূর। পথিকৃত হয়েছেন নারী শ্রমিকদের।
রেনু বলেন, 'মেয়েরা কিভাবে কাপড় সেলাইয়ের মেশিন চালায়, তা আমি শিখবো। এই একটা জেদ থেকেই আমার কাজ শুরু হয়। কাজে ভালো করাতে আমার অটো প্রমোশন হতে লাগলো। আমি জানিও না। একজন মেয়ে ইচ্ছা করলে সবই সম্ভব। মেয়েদের ক্ষমতা বেশি কিন্তু সাহস কম।'
অষ্টম শ্রেণীর পর পরিবারের হাল ধরতে নিভা বই-খাতা ছেড়ে হয়েছেন গার্মেন্টস কর্মী। ৬ বছরের কর্মজীবনে আত্মস্থ করেছেন জ্যাকেট সেলাইয়ের জিহি মেশিনের মতো ভারীসব যন্ত্র। নিভাও স্বপ্ন দেখেন রেনুর মতো সফলতার পথে হাঁটার।
নিভা বলেন, 'আমার এখানের সব কাজ শেখা শেষ। এই সেকশনের প্রতিটি মেশিন আমি চালাতে পারি। আমার মনে হয়, আমি এখানে সুপারভাইজারের দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে পারবো। আমি আগামীতে সুপারভাইজার হতে চাই।'
তৈরি পোশাকশিল্প বরাবরই নারী শ্রমিকের দখলে। রেনুর মতো স্বপ্ন দেখা অনেক নারী এসেছেন এ খাতে। দশকের পর দশক শ্রম দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন শ্রমিক কিংবা কর্মচারী থেকে কর্মকর্তা। যদিও গেল কয়েক বছরে কমেছে এ হার, কমছে মনোযোগী তকমা পাওয়া নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ।
টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল্লাহীল রাকিব বলেন, 'ছোট ছোট ব্যবসার খাত তৈরি হচ্ছে। নারী শ্রমিকরা সেখানে আরও অংশগ্রহণ করছে। সেক্ষেত্রে এখন কিছু কিছু করছে। কিন্তু আমরা তা বাড়াতে চেষ্টা করছি।'
পোশাক শিল্পে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও বৈষম্য কমেনি পদোন্নতির ক্ষেত্রে। তাই শুধু মুখেই উন্নত দেশ নয়, তাদের আদলে কারখানার কর্মপরিবেশ নিশ্চিতে মানসিক পরিবর্তনের পাশাপাশি সামাজিক সুবিধা বাড়ানোর কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, 'একই গ্রেডে নারী ও পুরুষ কাজ করছে, সে বৈষম্য নেই। গড় মজুরির দিক দিয়ে নারী শ্রমিক পুরুষদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। আমরা একদিকে বলছি যে, আমরা উন্নয়নশীল দেশে পৌঁছে যাচ্ছি। কিন্তু যে কার্যক্রমে আমরা কারখানাগুলো চালাচ্ছি, তা আসলে কখনোই একটি উন্নত দেশের কাঠামো নয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৮০ সালের ৮০ শতাংশ নারী শ্রমিকনির্ভর পোশাক খাতে ২০১৫ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ৫৪ শতাংশে আর ২০২১ সালে যা দাঁড়িয়েছে ৫৩ শতাংশে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস, যে দিনটির সাথে জড়িয়ে আছে নারী পোশাক শ্রমিকের ইতিহাস। স্বল্প মজুরিতে নারী শ্রমিকের সস্তা শ্রম কেনার প্রতিবাদে গড়ে উঠেছিল যে আন্দোলন, তা এখন অনেকটাই সফল। কেননা সময়ের সঙ্গে বদলেছে কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের পার্থক্য। যদিও দেশের সর্বত্র এখনও পুরোপুরি দূর হয়নি নারী শ্রমিকদের শোষণ।
তাই ঘরে কিংবা বাইরে নারীকে যে জেগে ওঠার কথা বলা হচ্ছে, তা বাস্তবায়নে কাঠামোগত পরিবর্তনের পাশাপাশি নিজস্ব উদ্যোগ আর স্বদিচ্ছার প্রয়োজন।