অপরাধ ও আদালত
বিশেষ প্রতিবেদন
0

গাজীপুরের আতঙ্ক ছিনতাই; আসামিরা জামিনে বেরিয়ে একই কাজে জড়াচ্ছেন

শিল্পনগরী গাজীপুরে আশঙ্কাজনকহারে বেড়েছে ছিনতাই। প্রায়ই ছিনতাইকারীদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হচ্ছেন পুলিশ, সাংবাদিকসহ সাধারণ পথচারী। এতে আতঙ্কিত নগরবাসী। পরিস্থিতি মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে এগিয়ে আসার আহ্বান পুলিশের। অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করেন, সাজা না হওয়াসহ বেশকিছু কারণে আসামিরা জামিনে বেড়িয়ে আবারও জড়াচ্ছেন ছিনতাইয়ে।

টঙ্গীর বিআরটি ফ্লাইওভারে দিনে-দুপুরে অস্ত্রের মুখে তরুণকে জিম্মি করে সবকিছু নিয়ে নেয় ছিনতাইকারী। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল এই ছিনতাইয়ের ভিডিও।

এটা ছিল দিনের চিত্র। এখন জানবো, এই ফ্লাইওভারের সন্ধ্যার চিত্র কেমন হয়?

সন্ধ্যা হলেই অন্ধকারে এক ভুতুড়ে পরিবেশ তৈরি হয় টঙ্গীর বিআরটি ফ্লাইওভারে। এই ফ্লাইওভারে নেই কোনো সড়ক বাতি, সিসিটিভি ক্যামেরা কিংবা পুলিশের টহল। ফলে দূর-দুরান্ত থেকে আসা যাত্রীরা বাস থেকে নামার পর আগে থেকেই ওৎ পেতে থাকা ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হন অনেকেই।

সড়কে পুলিশের উপস্থিতি কম থাকার সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে অপরাধীরা। দিনের বেলায়ও চলাফেরা করতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন শিল্প এলাকার সাধারণ মানুষ।

এই এলাকায় বসবাসকারী একজন বলেন, 'আমরা রাস্তাঘাটে আগের মতো পুলিশের উপস্থিতি দেখছি না, অনেকটা কম। আর এই সুযোগটাই নিচ্ছে কিছু ছিনতাইকারী।'

স্থানীয় একজন বলেন, 'গাড়ি থেকে যখন নামে তখনও ছিনতাই হয়। গাড়ি থেকে নামার সাথে সাথেই মোবাইল, টাকা-পয়সা নিয়ে নেয়। না দিলেই সমানে কোপায়।'

একই অবস্থা টঙ্গীর স্টেশন রোডের। গেল ২৩ ডিসেম্বর ভোরে কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে এই সড়কে ছিনতাইয়ের শিকার হন ইন্স্যুরেন্স কর্মকর্তা আমজাদ হোসেন। থানায় গিয়েও প্রতিকার পাননি। অভিযোগ করেন ছিনতাইয়ের শিকার আরও কয়েকজন ভুক্তভোগী।

আমজাদ বলেন, '২৩ তারিখের পর থেকে আমি এখনও পর্যন্ত থানায় দৌড়াদৌড়ি করে কোনো লিখিত অভিযোগও দিতে পারিনি, কোনো মামলাও দিতে পারিনি। আমার জন্য তারা োনো পদক্ষেপও নেয়নি।'

ছিনতাইয়ের চিত্র তুলে ধরতে টঙ্গী ফ্লাইওভারে টিম এখন টিভি। নজর পড়ে ওৎ পেতে থাকা দু'জনের প্রতি। এরপর তাদের সঙ্গে যোগ দেয় আরও কয়েকজন। বাস যাত্রীদের টার্গেট করে চলে পকেট থেকে মোবাইল-মানিব্যাগ নেয়ার চেষ্টা।

এদিকে ফ্লাইওভারে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আহত হয়ে বেশিরভাগ ভুক্তভোগী আসেন শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে। কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রতিদিন অন্তত পাঁচ থেকে ছয়টি ছিনতাইয়ের শিকার রোগী আসে হাসপাতালে। যার অধিকাংশই মধ্যরাত ও ভোরে।

শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ইনচার্জ মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'রাত ৩টা থেকে শুরু করে ভোর ৬টা পর্যন্ত বেশিরভাগ রোগী আসে। বেশিরভাগ সময় আমরা দেখি সব ধারালো অস্ত্রের কোপ।'

অনুসন্ধানে দেখা যায়, টঙ্গীর প্রায় ১৯টি বস্তি ঘিরে চলে মাদকের জমজমাট ব্যবসা । মাদকসেবীরা টাকা জোগাড় করতে জড়াচ্ছে ছিনতাইয়ে। পুলিশ বলছে, ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারির মধ্যভাগ পর্যন্ত টঙ্গীর বিভিন্ন এলাকা থেকে অন্তত দেড় শতাধিক ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। শুধু পুলিশ দিয়েই ছিনতাই ঠেকানো সম্ভব নয়। প্রয়োজন সামাজিক প্রতিরোধ।

গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার এন এম নাসিরুদ্দিন বলেন, 'এত ঘনবসতিপূর্ণ একটা জায়গা। সেখানে একটা জেলার সমান পুলিশও এখানে নেই। আমরা পুলিশের তরফ থেকে যেটা করার সেটা করেছি। এটা প্রশমনের জন্য শুধু পুলিশের উপর ভরসা করলে হবে না।'

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, ছিনতাইয়ের সম্মুখীন হওয়ার পর অনেক সময় ঝামেলা এড়াতে মামলা করতে চান না ভুক্তভোগীরা। আবার মামলা হলেও ছিনতাইকারী শনাক্ত না থাকায় এজাহার থাকে দুর্বল। এতে আদালত থেকে সহজে জামিনে বেরিয়ে আবারও অপরাধে জড়িয়ে পড়ে অপরাধীরা।

আইনজীবী ও অপরাধ বিশ্লেষক মো. আসাদুল্লাহ বাদল বলেন, 'সেহেতু ছিনতাইকারীরা শনাক্ত থাকে কম ফলে মামলাগুলোর এজাহার থাকে দুর্বল। আর যাদের অজ্ঞাত আসামি হিসেবে চালান দেয়া হয় তাদের ঘটনার সাথে সম্পর্ক অনেকক্ষেত্রে থাকে না। এসব কারণে যারা প্রকৃত অপরাধী তারা অধরা থেকে যায়। আর যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তারা বিচারহীনতার মধ্যে পড়ে যায়।'

টঙ্গীর স্টেশন রোড, বিআরটি ফ্লাইওভার, টঙ্গী বাজার, ফায়ার সার্ভিস রোড, কাদেরিয়া টেক্সটাইল মিল, গাজীপুরা বাসপট্টি, দেওড়া, আউচপাড়া, দত্তপাড়া ও হকের মোড় এলাকায় সবচেয়ে বেশি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। এ অবস্থায় প্রশাসনের নজরদারি বাড়ানোর দাবি জানান স্থানীয়রা।

এসএস