প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অন্যান্য অজুহাত দেখিয়ে কিছুদিন আগেই রাজধানীর কাঁচাবাজারগুলোতে অধিকাংশ সবজি সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিল। তবে বর্তমানে কিছুটা দাম স্থিতিশীল হয়েছে। কিন্তু সবজির বাজার হঠাৎ করেই এমন উথাল-পাথাল কেন হয়? তা জানতে এখন টেলিভিশনের প্রতিনিধি দল রাজধানী থেকে তিনটি সবজি বাছাই করে। সেক্ষেত্রে করোলা এবং ফুলকপি ও শিমকে বেছে নেয় অনুসন্ধানী এই দলটি।
ঢাকার বাজারে প্রায় সব ধরনের সবজি আসে দেশের অন্যান্য জেলা থেকে। বাজার বিশ্লেষণে সেজন্য এখন টেলিভিশনের প্রতিনিধি দল বেছে নিয়েছে ঢাকার প্রতিবেশি জেলা মানিকগঞ্জকে।
পাতার শরীরে শিশির ভাঙেনি তখনও। অথচ ভোরের আয়েশি ঘুমে সমাপ্তি টেনে কৃষকের মাঠে মাঠে ব্যস্ততা। করছেন ফসলের পরিচর্যা।
গ্রামের নাম বারাহির চর। এখানেই নিজের ৬০ শতাংশ জমিতে করোলা চাষ করেছেন আবু সাঈদ। জানালেন খরচের ফিরিস্তি।
আবু সাঈদ বলেন, 'আমার ৬০ শতাংশ জায়গায় প্রতি শতাংশে দেড় হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আমি প্রতি শতাংশে ২০ থেকে ২৫ কেজি করে করোলা পেয়েছি। আর বিক্রি করেছি কখনও ৮০০ টাকা মণ। আবার কখনও এক হাজার ৬০০ থেকে এক হাজার ৭০০ টাকা মণ। এটা করোলার মানের উপর নির্ভর করে পেয়েছি।'
সাঈদের মতো আরও অনেক চাষী ক্ষেতে চাষ করছেন শসা, ধুন্দুল, পটল, বেগুন, শিম, ফুলকপি'র মতো সবজি। জমি থেকে উৎপাদিত ফসল তুলে কৃষকরা সাধারণত নিয়ে আসেন পাশের অস্থায়ী আড়তে।
মানিকগঞ্জের বাজারে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের সবজি। ছবি: এখন টিভি
একজন করোলা চাষী বলেন, 'বিক্রি করার হিসেবে কেজি হিসেবে হয়তো বের করা যাবে না। তবে প্রথমবার বাজারে যা বিক্রি করছি তা দুই হাজার ৮০০ টাকা ছিল। এরপর দুই হাজার ২০০ টাকা, তারপর থেকে দাম কমেছে।'
সবজির দর-দাম এবং বেচাকেনার বিষয়ে বিস্তারিত জানতে গোপনে ভিডিও ধারণ করে এখন টিভি।
জানা গেল, সবজির প্রাথমিক ক্রেতা স্থানীয় ব্যাপারীরা। পরিচিত কৃষকের ক্ষেত থেকে তুলে আনা পণ্য কেনেন তারা। দর হাঁকান আশেপাশের বাজার অনুযায়ী। যা পরিবর্তন হয় প্রায় প্রতিদিন। এবার দেখা যাক, এখন টিভির নির্ধারণ করা করোলার বাজার দর কত।
৯০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকায় প্রতি মণ করোলা কিনছেন স্থানীয় ব্যাপারীরা। অর্থাৎ কেজিতে ৩০ টাকা।
মানিকগঞ্জের একজন স্থানীয় ব্যাপারী বলেন, '৩০ মণ পর্যন্ত এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত কিনেছি। ঢাকায় পাঠাতে হলে লেবার খরচ আছে এবং আড়ৎদারদের দিতে হয়। সেক্ষেত্রে এক হাজার ৬০০ থেকে এক হাজার ৭০০ টাকা খরচ হয়ে যায়।'
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এসব পণ্য বিক্রি করেন এখানকারই বড় ব্যবসায়ীদের কাছে। যারা সবজিগুলো সরাসরি ঢাকা এবং অন্য জেলাতে পাঠান। দ্বিতীয় হাতেই পণ্যের দাম মণপ্রতি বাড়ে ২০০ টাকা। কিন্তু কেন?
এখন টিভির গোপর ক্যামেরায় বাজারের পাইকারি হাঁক। ছবি: এখন টিভি
স্থানীয় অন্য একজন ব্যাপারী বলেন, 'এক হাজার ৫০০ থেকে এক হাজার ৬০০ টাকা মন কিনেছি। আড়তদার, লেবার খরচ, গাড়ি ভাড়া দিয়ে কেজিতে ৪৫ টাকা লাগবে।'
স্থানীয় আড়ৎ ছাড়াও মানিকগঞ্জের জাগীর কাঁচাবাজার আড়তে ফসল বিক্রি করেন কৃষক। এখানে দেখা মিলে রকমারি সবজির। আরেক সবজি ফুলকপি নিয়ে জানতে কথা হয় ব্যবসায়ী বশির আহমেদের সাথে।
তিনি বলেন, 'আমার প্রতি কেজিতে উৎপাদন খরচ আছে ২০ থেকে ২৫ টাকা করে। এখন পর্যন্ত যে বাজারমূল্য পেয়েছি এটাতে আমাদের চালান আসবে কিন্তু লাভ হবে না। কারণ আমরা আগাম সিজনে যে ফুলকপিগুলো করি এটাতে খরচ অনেক বেশি।'
ঢাকায় পিস হিসেবে বিক্রি হওয়া ফুলকপি মানিকগঞ্জ আড়তে কেনা হচ্ছে কেজি অথবা মণে। বাজার দর অনুযায়ী এক হাজার ৮০০ টাকা মণ। সেক্ষেত্রে পিস প্রতি দাম পড়ে ৩৫ টাকার মতো। আর শীতকালীন আগাম সবজি শিম আড়ৎদাররা কৃষকের কাছ থেকে কিনছে এক হাজার ৬৫০ থেকে এক হাজার ৭০০ টাকা মণে। কেজি পড়ে ৪০ থেকে ৪২ টাকা।
এখানে শতকরা পাঁচ টাকা কমিশনে পাইকারদের কাছে সবজি বিক্রি হয় বলে দাবি করেন আড়ৎদাররা। তারপর পণ্য পাঠানো হয় ঢাকায়।
একজন আড়তদার বলেন, 'আমি কৃষকদের বিক্রি করে দিব। এরপর আমার লাভ হলো শতকরা পাঁচ টাকা। আর এখান থেকে পণ্য ঢাকা যাত্রাবাড়ি, কক্সবাজার মোকামে গাড়ি দিয়ে পাঠিয়ে দিই।'
আড়তদার কথা ধরে এবার ঢাকায় ফেরা হয় অনুসন্ধান দলের। জানতে চাওয়া হয় ঢাকার আড়তের বাজারদর কত।
রাতের কারওয়ান বাজারে ১০টার পরপর দেশের অধিকাংশ জেলা থেকে ট্রাকে চেপে সবজি পৌঁছায়। স্থানীয় আড়তের সবজির দামের সঙ্গে কতটা ফারাক ঢাকার আড়তের?
কারওয়ান বাজারে রাতে ট্রাক থেকে সবজি নামাচ্ছেন শ্রমিকরা। ছবি: এখন টিভি
বাজার ঘুরে দেখা যায়, কারওয়ান বাজারে কিছু সবজি বিক্রি হয় 'পাঁচ কেজিতে এক পাল্লা' হিসেবে। ফুলকপি, লাউ, চালকুমড়ার মতো সবজি শতক বা কুড়ি হিসাবে। এখানে করলা মানভেদে মিলছে ৪০০ টাকা পাল্লা, যা কেজিতে ৮০। শিমের পাল্লা ৪৮০ থেকে ৫০০, কেজিতে প্রায় ১০০। কারওয়ান বাজারে মানিকগঞ্জের ফুলকপি পাওয়া গেল না। এর চেয়ে মানে এবং আকারে ছোট লালমনিরহাটের প্রতি পিসের ফুলকপির বাজার চলছে ৩২ থেকে ৩৫ টাকায়।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেল, কৃষক পর্যায় থেকে ঢাকার খুচরা ব্যবসায়ীদের হাতে পণ্য পৌঁছায় কম-বেশি পাঁচটি হাত ঘুরে, যেখানে আছে নানা ধরনের সিন্ডিকেট। আর এতে উৎপাদন মূল্যের দ্বিগুণ বেড়েছে সবিজর দাম। এখন টেলিভিশনের কাছে স্বীকার না করলেও কয়েকজন পাইকার জানান, কারওয়ান বাজার ও ঢাকার অন্যান্য পাইকারি বাজারে ট্রাক থামলেই 'মাল ভাঙা'র খরচ গুণতে হয় দুই হাজার টাকা। এছাড়াও পরিবহন ও লেবার খরচের অযুহাত দিলেন তারা।
একজন ব্যবসায়ী বলেন, 'আমার এক ট্রাক পণ্য বিক্রি করতে সব খরচ দিয়ে ২১ হাজার টাকা খরচ হবে। লেবার বস্তাপ্রতি খরচ নেয়।'
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর নানান সংস্কারের রব উঠলেও বাজার সিন্ডিকেটে পরিবর্তন আসেনি বলে মতামত দেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ। ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি পদক্ষেপ না নেয়ার কারণেই অযৌক্তিকভাবে পণ্যের দাম বৃদ্ধির অভিযোগ তাদের।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, 'যেখানে ১৮ কোটি মানুষের স্বার্থ জড়িত সেটা হলো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যপণ্যের বাজার ব্যবস্থাপনা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখানে কিন্তু তারা সংস্কারের কথা বলেনি। এর কারণে ব্যবসায়ীরা মনে করলো যে আগে আমরা যেভাবে করেছি। এটা এখন এবারও চলবে।'
প্রশাসনের অস্থিরতা ও দুর্বলতায় বাজার সিন্ডিকেট আরও শক্তিশালী হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবীর। যা ভাঙতে দরকার সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ।
তিনি বলেন, 'এখন যে বাজারের পরিস্থিতি, এই যে বাজারের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি যারা তৈরি করে রেখেছে তাদের বিরুদ্ধে কি আমরা কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা দেখেছি। একটা অন্তত দৃষ্টান্তমূলক মাস্তি হতো, কারও লাইসেন্স ক্যান্সেল করে দেয়া হতো, সেটা তো হচ্ছে না। এ কারণেই তারা পার পেয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হয় এই সিন্ডিকেটকে যদি এখন আমরা ধরতে না পারি, তাহলে সেক্ষেত্রে আর কখনোই এই বাজারটাকে ঠিক করা যাবে না।'
এরইমধ্যে সরকার টিসিবি এবং বেসরকারি উদ্যোগে পণ্য বিক্রির মাধ্যমে সমান্তরাল বাজার সৃষ্টির ব্যবস্থা করছে। তবে সিন্ডিকেট দমাতে না পারলে স্থায়ী সমাধান আসবে না বলে শঙ্কা বাজার অর্থনীতিবিদদের।