দেশে এখন
0

শেখ হাসিনার সঙ্গে সুসম্পর্কই কি ভারতের মাথাব্যথার কারণ!

বাংলাদেশ-ভারতের কূটনীতি বহুপাক্ষিক হলেও, গত ১৫ বছরে এ সম্পর্ক রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের কিংবা সরকারের সঙ্গে সরকারের ছিল না। বিশেষজ্ঞ মত বলছে, দুই দেশের কূটনীতি পরিণত হয়েছিল এক দেশের ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে অপর দেশের ক্ষমতাসীন দলের সম্পর্কে। যে কারণে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সুসম্পর্ক মাথাব্যথার কারণ হয়ে গেছে ভারত সরকারের জন্য। এর প্রভাবে দ্বন্দ্ব দৃশ্যমান হয়ে উঠছে প্রতিবেশী দুই দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যেও।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশি ভারত। সীমান্ত, ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষাসহ বিভিন্ন দেশের মধ্যে সংযোগ অনস্বীকার্য। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতাসহ অনেক ক্ষেত্রেই এক সুতোয় গাঁথা দুই দেশের সম্পর্ক। এসব কিছু মাথায় রেখেই দু'দেশের মধ্যে বন্ধুসম সম্পর্ক যেমন এদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ভারতের জন্যও।

গেলো বছর সেপ্টেম্বরেও বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতে আপ্যায়ন করেন সেদেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বিশ্বের শীর্ষ ২০ অর্থনীতির জোট জি-টোয়েন্টির শীর্ষ সম্মেলনে বিশেষ অতিথি ছিলেন শেখ হাসিনা। বলা হয়, কোনো প্রতিবেশী দেশের প্রতি এ ধরনের উষ্ণতা ভারত অতি ঘনিষ্ঠ মিত্রদেরই দেখিয়ে থাকে।

কিন্তু এক বছর পর শেখ হাসিনার সঙ্গে এই ঘনিষ্ঠতাই মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারত সরকারের জন্য। টানা ১৫ বছর শাসনের পর গেলো মাসে ছাত্র আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়ে আশ্রয় নেন ভারতে গিয়ে। সরকারের পতনের পর থেকেই শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেয়ায় নয়াদিল্লির তীব্র সমালোচনায় মুখর বিভিন্ন মহল। তাকে দ্রুত দেশে ফেরত পাঠানোর আহ্বানও জানান অনেকে।

শুধু তাই নয়, বর্ষা মৌসুমে দুদেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি অভিন্ন নদীতে দেয়া বাঁধ ভারতীয় প্রশাসন খুলে দেয়ার পর বাংলাদেশে ব্যাপক বন্যা এবং বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ভারতের ভিসাদান কার্যক্রম সীমিত করে আনাকেও আঘাত হিসেবে দেখছেন অনেকে। ২০২৩ সালে ভারতে ভ্রমণ করেছেন প্রায় ১৬ লাখ বাংলাদেশি। পর্যটন ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে বরাবরই বাংলাদেশিদের অন্যতম পছন্দের গন্তব্য ভারত।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ অধ্যাপক সাহাব এনাম খান বলেন, 'বিজেপি বাংলাদেশের যে বাকি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল গুলো ছিল এবং সাধারণ জনগণের যে রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা এটার প্রতিফলনকে অনুধাবন করতে পারেনি। সে কারণে আমার মনে হয় প্রধানমন্ত্রী ভারতে অবস্থান করার কারণে অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে দিল্লী সরকারের একটা রাজনৈতিক তর্ক তৈরি হলেও বাংলাদেশের সাথে তার যে লিগ্যাল বা ডিপলোমেটিক সম্পর্ক আছে সেক্ষেত্রে কিছুটা হলও টেনশন দেখা যাচ্ছে।'

কূটনীতি আর বাণিজ্যেও নয়াদিল্লি আর ঢাকার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। বিশেষ করে কয়েক দশক ধরে শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগের ভারতপন্থি ভাবমূর্তি জোরালো হয়েছে। ভোটের বৈধতা দেয়া ও গণতন্ত্রবিরোধী কার্যকলাপ, বিরোধী মত দমনসহ অনেক গুরুতর অভিযোগ থাকা শেখ হাসিনাকে এক যুগের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় রাখতে নয়া দিল্লির সহযোগিতা ছিল বলেও অভিযোগ অনেকের।

আবার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে সাম্প্রদায়িক হামলা, বিশেষ করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নিরাপত্তা ইস্যুতে ক্ষোভ ছড়িয়েছে ভারতেও। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গণেও নিয়ে গেছেন মোদি। যদিও, দেশে সাম্প্রদায়িক হামলা প্রতিরোধে অন্তর্বর্তী সরকার বদ্ধপরিকর জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ফোনালাপ করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। একইসঙ্গে, দেশে হিন্দুসহ সংখ্যালঘু ও আদিবাসীগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিতের প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি। এছাড়াও, গণতন্ত্র, স্থিতিশীলতা ও শান্তি ফেরানোর পাশাপাশি প্রগতিশীল বাংলাদেশ গড়তে ভারতের সহযোগিতাও চান প্রধান উপদেষ্টা।

তবে সম্প্রতি ভারতীয় বার্তা সংস্থা পিটিআইকে ড. ইউনূসের দেয়া সাক্ষাৎকার প্রকাশের পর কিছুটা থমথমে দুই দেশের কূটনীতি। ভারতে বসে বাংলাদেশ নিয়ে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক মন্তব্য দুইদেশের বন্ধুত্বের আভাস নয় বলে মন্তব্য করেন প্রধান উপদেষ্টা। উল্লেখ করেন শেখ হাসিনার বিবৃতি নিয়ে দেশে অস্বস্তি এবং বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের অবনতির কথাও। হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনা অতিরঞ্জিত আকারে প্রকাশ করা হচ্ছে বলেও ভারতের দিকে প্রশ্নও ছুঁড়ে দেন ড. ইউনূস। এসব ঘটনাপ্রবাহের মধ্যেই চলতি মাসের শেষে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনের সাইডলাইনে মোদির সঙ্গে সাক্ষাতে আগ্রহ প্রকাশ করেন ড. ইউনূস এবং এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি নয়াদিল্লি।

অধ্যাপক সাহাব এনাম খান আরো বলেন, 'গত ১৫ বছরে এইটা ছিল একটা এককেন্দ্রীয় রাজনৈতিক সম্পর্ক। যার ফলে বাংলাদেশের সাথে ভারতের রাজনৈতিক সম্পর্ক বেশী।'

এমন পরিস্থিতিতে তিন দিক থেকে ঘিরে থাকা প্রতিবেশী এবং দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ অর্থনীতির দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক ভবিষ্যতে কোনদিকে মোড় নেয়, তা দেখায় অপেক্ষায় দু'দেশের জনগণ।