বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে সাক্ষাৎকার দিতে এসে অপহরণের শিকার হয়েছিলেন ডা. আব্দুল আলীম। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ২০১৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর উপাচার্যের ভবনের সামনে থেকে তুলে নেয়া হয় তাকে।
এখানেই শেষ নয়, এই অপহরণে যে সকল চিকিৎসক জড়িত ছিলেন, তাদের পরিচয় মিললেও কখনও ব্যবস্থা নেয়নি কোনো প্রশাসন। পরিবারকেও পড়তে হয় চরম অনিশ্চয়তায়। তার স্ত্রী দিল আফরোজা খাতুন জানালেন, শঙ্কা ছিল প্রাণ নাশের।
দিল আফরোজা খাতুন বলেন, 'অনেকের কাছে গিয়েছি, অনেকের কাছে হাতজোড় করেছি, আমি ভুলে গিয়েছি যে আমি কে। আমার শুধু মনে হয়েছিল আমার বাচ্চা দু'টো অনেক ছোট। এ অবস্থায় ওর বাবা নাই হয়ে গেলে আমি কীভাবে মানুষ করবো। আমি ভেবেছিলাম যে ওর সাথে আমার আর কখনও দেখা হবে না। কারণ তখন যাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তারা কেউ তো ফেরেনি।'
অ্যানেসথেসিওলজিস্ট ডা. আব্দুল আলীম ২০১০ সালে বিএসএমএমইউ এর সহকারি অধ্যাপক পদে নিয়োগের সুপারিশপ্রাপ্ত হন। যদিও গেল ১৪ বছরেও তার নিয়োগ চূড়ান্ত হয়নি। এই লড়াইয়ে তাকে যেতে হয়েছে ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে।
ডা. এস এম আব্দুল আলীম বলেন, 'আমাকে আটকে রাখা হয়েছে, অপহরণ করা হয়েছে। এবং আমি যদি কোনো মামলার আশ্রয় নেই তাহলে তারা আমাকে মেরে ফেলবে। বারবার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে বলা হয়েছে।'
এ নিয়ে বাংলাদেশ সোসাইটি অফ অ্যানেস্থেশিয়া ক্রিটিক্যাল কেয়ার এন্ড পেইন ফিজিসিয়ান বলছে- অন্যায় জেনেও প্রতিকার মেলেনি।
বিএসএ-সিসি-পিপির সদস্য সচিব ডা. মোহাম্মদ শামসুল আরেফীন বলেন, 'তার যদি সমস্ত কিছু আপটুডেট থাকে তাহলে যে অবশ্যই উনাকে নিয়োগ দেয়া হয়। এবং তার বর্তমানে যে পদবি পাওয়া উচিত সেই পদবিতে যেন তাকে পদায়ন দেয়া হয়।'
গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সরকারের আমলে ডা. আব্দুল আলীমের মতো রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অনেক ঘটনা ঘটেছে, দেশের সবচেয়ে কার্যকর মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় বিএসএমএমইউ'তে। চিকিৎসকদের অভিযোগ, পদায়ন বা পদোন্নতিতে যোগ্যতার চেয়েও বেশি বিবেচনা হয়েছে রাজনৈতিক পরিচয় ও অনৈতিক লেনদেন।
বিএসএমএমইউ কলোরেক্টাল সার্জন ডা. মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, 'একমাত্র বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে ১০০ ভাগ দলীয়করণ করা হয়েছে। দলীয় লোকদের নেয়া হয়েছে। টাকা ছাড়া কিছুই হয়নি এখানে, এমনকি তার দলীয় লোক হলেও টাকা দিতে হয়েছে। এখানে একটা সহকারী অধ্যাপক নিয়োগের জন্য ৪০ থেকে ৬০ লাখ টাকাও লেনদেন হয়েছে।'
সেবাদাতাদের অভিযোগ, হাসপাতালটিতে আইন ভঙ্গ করে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বহু চিকিৎসককে, যার প্রভাব পড়েছে হাসপাতালের সেবা ও গবেষণাতে।
বিএসএমএমইউ রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. কাজী মো. কামরুল ইসলাম বলেন, 'বিভাগীয় প্রার্থীদের বাদ দিয়ে তারা বাইরে থেকে সরকারি বা বেসরকারি চাকুরিরত ব্যক্তিদের নিয়োগ দিচ্ছিল সহকারী অধ্যাপক পদে।'
বিএসএমএমইউ মেডিসিন ও বাত ব্যথা বিশেষজ্ঞ ডা. মো. নাহিদুজ্জামান সাজ্জাদ বলেন, '২০১৬ সালে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ডিগ্রি এমডি কমপ্লিট করেছি। এ পর্যন্ত আমার ৩৫টি গবেষণা পত্র আছে দেশি এবং বিদেশি বিভিন্ন জার্নালে। আসলে আমাদের মূল্যায়ন না করার কারণে আমরা হতাশাগ্রস্ত হই।'
বিএসএমএমইউ সহকারি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেন, 'দলবল নির্বিশেষে শুধু ডাক্তারদের যোগ্যতা থাকবে। যোগ্যতা অনুসারে তার প্রমোশন হবে। সবকিছু রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকতে হবে।
ভুক্তভোগী চিকিৎসকদের অভিযোগ, শিশু সার্জারির মতো অসংখ্য বিভাগে বহুদিন ধরে পদবঞ্চিত হয়েছেন যোগ্যরা।
বিএসএমএমইউ পেডিয়াট্রিক সার্জারি বিভাগ অধ্যাপক ডা. কে এম দিদারুল ইসলাম বলেন, 'প্রায় ১৩ বছরের জুনিয়র। ২০১১ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে ল্যাটারাল এন্ট্রি হিসেবে ঢুকেছে। তার কোনো সরকারি চাকরির অভিজ্ঞতা ছিল না। সে এমবিবিএসে আমার জুনিয়র, এমএসে জুনিয়র। আমি পরীক্ষা দিয়েছি তার সাথে কিন্তু তাকে নেয়া হয়েছে কিন্তু আমাকে নেয়া হয়নি। সে এখন চেয়ারম্যান।'
বিএসএমএমইউ কনসালটেন্ট সার্জন ডা. মো. নজরুল ইসলাম আকাশ বলেন, '২০০৮ সালে আমি পোস্ট-গ্রাজুয়েশন করারর পর আমার সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ার কথা কিন্তু বাইরে থেকে তারা তিন থেকে চারজনকে নিয়োগ দিয়েছে বিভিন্ন ধাপে ধাপে।'
বিএসএমএমইউ'তে এরই মধ্যে পরিবর্তন এসেছে প্রশাসনে। তারা বলছেন, অধিকার বঞ্চিতদের যথাযোগ্য মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করা হবে।
বিএসএমএমইউ উপ-রেজিস্টার ডা. মো. রুহুল কুদ্দুস বিল্পব বলেন, ' ক্রাইটেরিয়া ফুলফিল হলে সে তার পরের গ্রেডে পদোন্নতি পাবেন। এই যে নিয়মটা ছিল সেটা ২০০৯ সালে তৎকালীন ভিসি সিন্ডিকেট করে বাদ দিয়ে দিয়েছেন। এরপরই যত জটিলতা তৈরি হয়েছে। ২০৩৩ থেকে ২০০৬ এ নিয়োগ প্রাপ্ত মেডিকেল অফিসারদের জন্য বাতিলটি প্রযোজ্য হবে না। শুধু এই জিনিসটিই যদি সিন্ডিকেট করে তাহলে সব মেডিকেল অফিসারদের জন্য যে বঞ্চনার বিষয়টি তা ঘুচে যাবে।'
স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়টি চিকিৎসা সেবায় রোগীদের আস্থা ফেরানোর পাশাপাশি চিকিৎসকদের গবেষণামুখী করতে নানা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে আগামী ১০০ দিনের মধ্যেই দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখা যাবে, যার সুফল পাবেন সবাই।