নিহত ছেলের স্মৃতি বুকে জড়িয়ে মারুফের বাবার আহাজারি যেন থামছেই না। বুকের ধনকে হারানোর শোক ঝড়ছে বাবার কান্না হয়ে। বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলে ক্রিকেটার হবে। খেলেছিল বয়সভিত্তিক দলেও। চলমান সহিংসতায় গুলির আঘাতে স্তব্ধ হয়ে যায় ছেলে মারুফের হৃদস্পন্দন।
মারুফের বাবা বলেন, 'আমার ছেলে খুব স্মার্ট ছিল। রোববারে পোস্ট-মর্টেম করে যখন আমাকে দেয়, তখন আমি ডাক্তারকে বলেছি, আমার ছেলে কীভাবে মারা গেলো, বলে গুলি খেয়ে মারা গেলো। আমার ছেলে চোর, না ডাকাত না কি, কোনো অপরাধ নাই। মারুফ কোনো আন্দোলনেও যেতো না। রাস্তায় মারা হয়েছে ওকে।'
মারুফের কক্ষে ব্যাট, গ্লাভস ও হেলমেট থাকলেও মারুফ নেই। এই পরিস্থিতিতে থমকে গেছে আরও অনেক কিশোরের স্বপ্নযাত্রা।
একমাত্র ছেলে হারানোর শোকে ক্ষণে ক্ষণে চোখ মুছছেন ইসলামের মা তসলিমা বেগম। অভাবের সংসারে হাল ধরতে চাকরি নিয়েছিল জুতা কারখানায়। ছেলের খাবার বাটি ও কাপড় দেখতেই মায়ের চোখে নোনাজল চলে আসে।
১৮ জুলাই, শুক্রবার ছুটির দিনে মোহাম্মদপুর নানু বাড়ি যাচ্ছিলো ১৫ বছর বয়সী ইসলাম। গুলিবিদ্ধ হয়ে রায়েরবাজার ফুটপাতেই থেমে যায় এই কিশোরের জীবনযাত্রা।
ইসলামের মা বলেন, 'আমার ছেলে কোনো মিছিল বা আন্দোলনে যায় নি। আমার ছেলে সাধারণ একজন মানুষ। ছেলেরে একটা গুলিই মাথায় করছে উপর থেকে।'
সাইকেল চড়ে ছুটে বেড়াতো আব্দুলাহ ইফতি। বুলেট থামিয়ে দিলো এই কিশোরের দুরন্তপনা। ৬ মাস আগে কেনা ছেলের সাইকেলে পাশে দোয়ারত বাবা আর দরজার বাহিরে অসহায় মায়ের চাহনি। অকালেই কেন ঝড়লো প্রাণ, উত্তর খুঁজছে বাবা-মা।
ইফতির বাবা বলেন, 'আব্দুলাহ প্রতি শুক্রবারেই পুকুরে গোসল করতে যেতো। সাঁতার কাটে পুকুরে। সেদিন গোসল করতে গেলে গোসল করে আর আসেনি। আমি অর্ধেক রাস্তা আসার সময় আমার মেয়ে ফোন দিয়ে বলে যে, আব্বা আব্দুল্লাহ তো মারা গেছে। ওর লাশ নিয়ে আসছে। বাসায় আসলাম, এসে দেখি এই উঠোনের মধ্যে আমার ছেলের লাশ।'
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলমান সহিংসতায় নিহতের সংখ্যা ১৫০, কিন্তু বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে সে সংখ্যা দুই শতাধিকেরও বেশি। তবে হতাহতের এসব ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন মানবাধিকার কর্মীরা।
মানবাধিকার কর্মী আহমেদ স্বপন মাহমুদ বলেন, 'কখনও এটা ঘটতে পারে না। এটা সাধারণ নিরীহ মানুষ হোক, ছাত্র, কিশোর বা শিশু যেই হোক কারও সাথে ঘটতে পারে না। এটা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের পরিপন্থী। এমনকি আমাদের সংবিধানেরও পরিপন্থী। নিরীহ শিশু-কিশোর, ছাত্র-জনতার ওপর কোনো আক্রমণ করা যাবে না। এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হলে সেটাও আইন অনুযায়ী বিশেষ পরিস্থিতিতে অনেক সময় পুলিশ গুলি করতে পারে।'
সুষ্ঠু তদন্তসহ বিচার নিশ্চিত ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা হলেই এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মীরা।