পিঠে বড় ভাইয়ের হাত, আছে রাজনৈতিক পরিচয়। দেশি-বিদেশি অস্ত্র হাতের মুঠোয়। মাদকে বুঁদ হওয়ার প্রমাণ উন্মাদ অঙ্গভঙ্গি।
প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে বাঁধ ভাঙা উল্লাসে ডেইনজার গ্যাং এর সদস্যরা। ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার সাহসই বলে দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কতটুকু ভয় পায় গ্যাং সদস্যরা।
একই অবস্থা অ্যাটেম টু মার্ডার গ্যাং এর সদস্যদের। ভয়ডরহীন এসব কিশোর কলম ছেড়ে হাতে তুলে নিয়েছে অস্ত্র। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, জমি দখল, নারীদের উত্ত্যক্ত করার মতো ঘটনায় রাজধানীতে তাদের নাম আসছে সবার আগে।
বাস্তবতা ঘুরে দেখতে রাজধানীর উত্তরায় থেকে শুরু করতে চায় এখন টিভির প্রতিনিধি দল। এই এলাকায় ৩০টির বেশি কিশোর গ্যাং দাপট দেখাচ্ছে।
উত্তরার দোকানিদের মধ্যে একজন বলেন, 'রাস্তার কুকুরের মাথায় একদিন লিখে দিছে লাল রঙ দিয়ে। টিএ স্টার, ডিস্কো-ফিস্কো লিখে দিছে। এটা দেখে প্রমাণ পাওয়া যায় যে এটা আছে।'
কিশোর গ্যাং এর দাপটে অতিষ্ঠ ছোট ব্যবসায়ীরা। অনেক বছর ধরে চলা কিশোর গ্যাংয়ের দাপট থামাবে কে? এমন প্রশ্ন এক দোকানির।
সেই দোকানি বলেন, 'কিশোর গ্যাং বাড়বে না তো কি আমার মতো মুদি দোকানদার বাড়বে? আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছি, সব আল্লাহ দেখবে।'
কখনও গলিকেন্দ্রিক বা কখনও এলাকাকেন্দ্রিক, উত্তরায় ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করেছে কিশোর গ্যাং। এর আশপাশে যারা রয়েছেন তারাও অসুস্থ তাদের জ্বালাতনে। একসময় নিজেদের নামের জানান দিতে দেয়ালগুলোতে নিজেদের নাম লিখে রাখো হতো। এখন সেই নাম লেখার পদ্ধতি এবং প্রচারণার পদ্ধতি চলে গিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।'
বিচ্ছু বাহিনী, সাইফুল গ্যাং, বাবু রাজন গ্যাং এর দাপটে ভীত স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। তাদের কাছে সবসময় থাকে দেশি অস্ত্র।
আধিপত্য বিস্তার, পাড়ার নিয়ন্ত্রণ ও স্কুল মোড়ে দায়ী ছোট বাচ্চাদের মনস্তাত্ত্বিক ভাবে জিম্মি করা যাদের কাজ।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে বলেন, 'এরা পড়ালেখার প-ও বোঝে না। ১২টা বাজে এরা এদিকে আসে। সব দাপট দেখায়। আপনারা যদি ভিডিও করে থাকেন তাহলে পরে আমাদের সমস্যা হতে পারে।'
এর পরে অবস্থানেই রয়েছে মোহাম্মদপুর এলাকা। এখানে কম করে হলেও ২০টির বেশি গ্যাং এলাকা ভিত্তিক তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। এখানে কিশোর গ্যাং মানেই ছিনতাই, চাঁদাবাজি। নামে বেনামে ছড়িয়ে পড়া কিশোর গ্যাং এর সদস্যদের চিহ্নিত করাই এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বড় চ্যালেঞ্জ।
স্থানীয়দের মধ্যে একজন বলেন, 'পায়ের মধ্যে টেপ মেরে বাজারে টাকা নিয়ে যেতাম। টুপির ভেতর টাকা নিতাম।'
এবার আসা যাক নাম করা স্কুল কলেজের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে।
প্রায় সময় ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজ সংঘর্ষে জড়ায়। এখানে গ্যাং কালচার তৈরি হয় কলেজের নামকে সামনে রেখে। কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে কটূক্তি নিয়েই যত দন্দের সূত্রপাত।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে একজন বলেন, 'প্রতিবছরই এটা হয়। এর কোনো আলাদা কারণ থাকে না। এটা নিয়মিত হয়। ধরেন, আপনারে কেউ এসে আপনার ইনস্টিটিউশন নিয়ে কিছু একটা বললো, এটা নিয়ে গায়ে লাগে তারপরই লেগে যায়।'
বয়সের সাহসে সবকিছু মারিয়ে যাওয়া এসব কিশোরদের দিকে নজর পড়েছে শীর্ষ সন্ত্রাসীদেরও। তাদের দলে রেখে জমি দখল ও মাদক ব্যবসায় কাজে লাগায় তারা।
স্থানীয়দের মধ্যে একজন বলেন, 'আইনের মাধ্যমেই তাদের জামিন হচ্ছে। জামিন হওয়ার পর কিছু লোক আছে এই দিকে আর যেতে চায় না, আর কিছু লোক আছে যে, না- ত্রাস তৈরি করবো। এই জায়গা থেকে কিশোর গ্যাং তৈরি করার চিন্তা করছে বা তাদের লিড দেয়ার চিন্তা করছে।'
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঠানো একটি হিসাব বলছে, এখন সারাদেশে ২৩৭টির মতো 'কিশোর গ্যাং' রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঢাকা শহরে ১২৭টি। ঢাকার পর চট্টগ্রামে রয়েছে ৫৭টি। অন্যান্য জেলাগুলো মিলিয়ে কিশোর গ্যাং এর সদস্য রয়েছে ৫৩টি।
কিশোর গ্যাং দমনে অভিযোগের অপেক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
ডিএমপির মিডিয়া উইংয়ের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. তালেবুর রহমান বলেন, 'আমাদের স্পষ্ট বার্তা, কেউ যদি আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার চেষ্টা করে তাকে অবশ্যই আইনের মুখোমুখি হতে হবে। এবং এইক্ষেত্রে আমরা কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দিবো না।'
রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করা গেলে থামানো যাবে কিশোর গ্যাং, বলছে অপরাধ বিশ্লেষকরা।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, ' না পারছে কিশোরদের সংশোধন করতে, না পারছে পেছনের পৃষ্ঠপোষকদের আইনের আওতায় আনতে। সুতরাং দুইটি কাজই একসাথে চলমান রাখতে হবে। যেন কিশোররাও অপরাধপ্রবণ না হয়ে পড়ে। পাশাপাশি কোনো পৃষ্ঠপোষকই কিশোর অপরাধী বা কোনো গ্যাং তৈরি করে কোনো অপরাধ তৈরির সুযোগ যেন না পায়।'
সারাদেশে কিশোর গ্যাং সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রায় ৮০০ এর বেশি মামলা রয়েছে। তবে ৫ আগস্টের পরে নতুন করে দল গোছানো কিশোর গ্যাং সদস্যদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা গেলে কমে আসবে অপরাধ বলছে সমাজ বিশ্লেষকরা।