যমুনা-ব্রহ্মপুত্র যখন অশান্ত হয়ে ওঠে তখন বিধ্বংসী রূপে আঘাত হানে জনপদের পর জনপদে। বাড়ি-ঘর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দুমড়ে-মুচড়ে নিয়ে মুহূর্তেই নিঃস্ব করে এক কাতারে দাঁড় করায় গৃহস্থ-ভিখারী সব মানুষকে।
আর যাদের ঠিকানা নদ-নদীর গর্ভে জেগে ওঠা বালুচরে, তাদের সারা বছরের রোজগারের সবটুকু ধুয়ে-মুছে নিয়ে যায় বানের জল।
একজন ভুক্তভোগী বলেন, 'বন্যা হলে আমাদের সবকিছুর ক্ষতি হয়। কিছু করতে পারি না, বাড়ি-ঘর তলিয়ে যায়। খুব কষ্ট হয় আমাদের।'
বন্যার ভয়াল ছোবল থেকে বাঁচতে বানভাসিদের এমন আর্তনাদ যে কারও কানে ওঠে না, তা স্পষ্ট হয় প্রতি বন্যায়। ১৯৯৯ সালে বিদেশি এক বিশ্ববিদ্যালয়ের জরিপ বলছে- প্রতিবছর ব্রহ্মপুত্র নদে প্রবাহিত হয় ৭২১ মিলিয়ন টন পলি। যার মধ্যে ২২৩ মিলিয়ন টন পলি জমে বছরে যমুনা-ব্রহ্মপুত্র নদের তলদেশ ভরাট হয় ৩ দশমিক ৯ সেন্টিমিটার।
কিন্তু এ নিয়ে ভাবনা নেই কর্তৃপক্ষের। উজানের ঢল যখন বন্যা হয়ে ভাটির জনপদে ধেয়ে আসে তখন নদ-নদী খননের দাবি উঠলেও তা যেন আবার ভেসে যায় বন্যার স্রোতে।
উন্নয়নকর্মী এম আবদুস সালাম বলেন, 'নদী ড্রেজিং করলে পরিপূর্ণভাবে পরিকল্পিত উপায়ে করতে হবে। যা দিয়ে নদীর নাব্যতা বুদ্ধি পাবে। এর ফলে বন্যা মোকাবিলা থেকে শুরু করে অন্যান্য সম্পদের বিকাশ লাভও সম্ভব।'
বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আবদুল হাই বলেন, 'আমরা যদি নদীর দুই পাড় সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে পারতাম, নদীশাসন করতে পারতাম তাহলে নদীগুলোর চ্যানেল ঠিক থাকতো। এতে ক্ষয়ক্ষতিও কমাতে পারতাম।'
কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জের বুক চিরে অসংখ্য চ্যানেলে বিভক্ত হয়ে বয়ে চলেছে যমুনা-ব্রহ্মপুত্র। কোথাও কোথাও ১২ থেকে ১৫ কিলোমিটারেরও বেশি প্রস্থে রূপ নেয় বর্ষায়। তলদেশ ভরাট হয়ে ভাসিয়ে নেয় জনপদের পর জনপদ। অথচ পরিকল্পিতভাবে খনন আর ব্যবস্থাপনা থাকলে অভিশাপের বদলে সম্পদ আর আশীর্বাদ হতে পারে যমুনা-ব্রহ্মপুত্র।
এম আবদুস সালাম বলেন, 'আমরা নদীকে ভালো ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসতে পারলে তা দিয়ে বন্যা রোধ করা সম্ভব। এতে মানুষের দুর্ভোগ লাঘব করা যেমন সম্ভব তেমন ব্যাপক সম্পদ তৈরি করাও সম্ভব।'
নদী গবেষক ড. বেলাল হোসেন বলেন, 'আমরা যদি নদী খনন করে গভীর করতে পারতাম, তাহলে নৌপথ চলাচল সহজ হতো। এতে করে পণ্য আনা নেয়ার খরচ কমে যেতো। নদীকেন্দ্রিক জীবনযাত্রা সহজ হতো। পরিকল্পিত পরিকল্পনা পানি উন্নয়ন বোর্ড এখন পর্যন্ত করেনি।'
নদী বিধৌত জনপদে গাইবান্ধার সংসদ সদস্যও তুলে ধরলেন নদী খননের দাবি।
গাইবান্ধা-৫ এর সংসদ সদস্য মাহমুদ হাসান রিপন বলেন, 'উভয় পাশে স্থায়ীভাবে রক্ষার জন্য বাধ করতে হবে। এতে নদীর পানির প্রবাহ ঠিক থাকবে। এখানে কৃষিকাজ ব্যাহত হবে না। আমাদের নদী ভাঙন রোধ হবে। এরকম একটা স্থায়ী প্রকল্প সরকারের নেয়া উচিত এবং এ প্রকল্প নিলে আমরা শুধু এই অঞ্চল না, সারাদেশের নদীপাড়ের মানুষ রক্ষা পাবে এবং তাদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটবে।'
দেশের বৃহত্তম নদ ব্রহ্মপুত্র খননে কী ভাবছে পানি উন্নয়ন বোর্ড, এমন প্রশ্নে প্রতিষ্ঠানের এই কর্তা জানালেন- এখনই বড় বড় নদ-নদী খননে কোনো উদ্যোগ নেই তাদের।
রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মুখলেছুর রহমান বলেন, 'ছোট নদীগুলোকে ক্ষেত্রে নদী এবং খাল খনন প্রকল্প আছে। এটার প্রথম ফেস আমরা কমপ্লিট করেছি। ৬৫ জেলাতেই এটা করা হয়েছে। একনেক থেকে পাস হলে দ্বিতীয় ফেস শুরু হবে। নদী নিয়ে পরিকল্পনা আমাদের অবশ্যই আছে আর আমরা পর্যায়ক্রমে এটা করছি।'
একদিকে বন্যা-ভাঙন রোধে স্থায়ী তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই। অন্যদিকে বছর বছর বন্যা আর নদী ভাঙন কত শত মানুষকে নিঃস্ব করছে তাদের পুনর্বাসন দূরের কথা, নাম ঠিকানা, পরিসংখ্যান জায়গা পায় না সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলোতে।