সকাল ৯ টা ৪৫ মিনিট গিয়ে দেখা যায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বহির্বিভাগে সকাল ৮ টা থেকে ডাক্তার থাকার কথা থাকলেও এখনো আসেননি তিনি। এদিকে রোগীদের অপেক্ষার দীর্ঘ সারি যেন পরিণত হয়েছে ভোগান্তিতে।
বহির্বিভাগের টিকিট সংগ্রহ করে দীর্ঘ সারিতে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কক্ষের সামনে অপেক্ষা করছেন রোগীরা, কখন আসবেন ডাক্তার? কখন মন খুলে বলবেন তার রোগের কথা?
প্রহর গুণতে গুণতে পেরুলো ঘণ্টা, রোগীর সারিও ধীরে ধীরে হচ্ছে আরও লম্বা। চিকিৎসক তখনো প্রবেশ করেননি। এ চিত্র এক দিনের নয়। এভাবেই প্রতিদিন অপেক্ষা করতে হয় সেবা নিতে আসা মানুষদের। অসুস্থতা সারাতে এসে এমন অবস্থায় কেউ কেউ যেন আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
ডাক্তার দেখাতে আসা একজন বলেন, 'ডাক্তার আসার কথা সকাল ৮টায় আমরা সকাল ৬টা থেকে ৮টা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে আছি। ডাক্তার ঠিক সময়ে আসছে না দেখে এতো ভোগান্তি বাড়ছে।'
আরেকজন বলেন, 'ডাক্তার দেরি করায় লাইন দীর্ঘ হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ যদি বিষয়টা নজরে নেয় তাহলে এত ভোগান্তি হতো না আমাদের।'
শুধু মেডিসিন নয়, এই চিত্র অন্য বিভাগেও। দেরি করার পেছনে যুক্তি দেখালেন চিকিৎসকরা।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এফসিপিএস মেডিসিন ট্রেইনি ডা. দবিরুল ইসলাম বলেন, 'আজকে একটু দেরি হয়েছে। এছাড়া আমি ঠিক সময়েই আসি। আজকে রোগীর চাপ কম আছে। দেখে নিতো পারবো। সমস্যা হবে না।'
প্রথমে চিকিৎসকদের দেরি করে আসার বিষয়টি এড়িয়ে গেলেও পরে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানালেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. শফিউর রহমান।
তিনি বলেন, 'আমার চোখে কেউ ফাঁকি দিতে পারে না। যদি কেউ এমন দেরি করে আসে তাহলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নিবো।'
সেবা নিতে আসা রোগীরা বলছেন, চিকিৎসকের রুমে ঢোকার সুযোগ পেলেও ১ থেকে ২ মিনিটের মধ্যে হাতে ধরিয়ে দেয়া হয় ব্যবস্থাপত্র। রোগীর চাপে চিকিৎসকের আন্তরিকতার জায়গা কম থাকে বলেও মনে করেন রোগীরা।
রোগীদের একজন বলেন, 'বেশিরভাগ ডাক্তার রোগীর পুরো কথা না শুনে ওষুধ লিখে দেয়।'
আরেকজন বলেন, 'আমরা যে তাদের কাছে গিয়ে বসবো, কি সমস্যা হয়েছে তা বলবো সেই সময়ও তাদের কাছে থাকে না।'
এদিকে প্রাথমিক পরামর্শের জন্য রোগী কোথায় যাবেন, কোন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে সেবা নেবেন, কতটুকু অসুস্থ হলে কোন পর্যায়ের হাসপাতাল কিংবা বিশেষজ্ঞের কাছে যাবেন নেই এ সংক্রান্ত কোনো গাইডলাইন। এতে বেশিরভাগ সময়ই রোগী ভুল করে অন্য রোগের বিশেষজ্ঞের কাছে চলে যান। এ অবস্থা নিরসনে চিকিৎসাক্ষেত্রে স্ট্রাকচারাল রেফারেল পদ্ধতি চালুর ওপর গুরুত্ব দেয়ার কথা বলছেন চিকিৎসকরা।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. দেবাশীষ সাহা বলেন, 'কোনো জরুরি বিভাগের রোগী যদি বহির্বিভাগে চলে যায় স্বাভাবিকভাবেই তার চিকিৎসা পেতে দেরি হবে। এখানে যদি এরিয়া ভাগ করে রেফারেল পদ্ধতি চালু করা যায় তাহলে এই সমস্যা দূর হবে।'
রোগীর চাপ যেমন বেশি রয়েছে তেমনি কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। সমন্বয়ের জন্য অভ্যন্তরীণভাবে বিভিন্ন বিভাগের ইনডোর আউটডোরের চিকিৎসকের মাধ্যমে সর্বোচ্চ সেবা দেবার চেষ্টা চলছে।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. নিয়াতুজ্জামান বলেন, 'আমাদের যে বিভাগগুলো রয়েছে সবগুলো আন্তঃবিভাগ ও বহির্বিভাগ রয়েছে সেখানকার ডাক্তাররা দুই জায়গাতেই সেবা দিচ্ছে।'
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, সময় মতো হাসপাতালে আসা নিয়ে কখনো কখনো চিকিৎসকদের গাফিলতি থাকে। এক্ষেত্রে জনবল একটি বড় সমস্যা। তবে বড় একটি অংশ ঠিক সময়ে আসে আর দেরিতে যায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতালও ক্লিনিক শাখা পরিচালক ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বলেন, 'একজন চিকিৎসককে তার সক্ষমতার চেয়ে তিনগুণ চারগুণ কাজ করতে হচ্ছে এতে চাপ বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে রোগীদের যে সেবা দেয়ার কথা তা দিতে পারছে না।'
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যবস্থাপনার ত্রুটি সমাধানে দেশে রেফারেল পদ্ধতি চালু করতে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার পাশাপাশি চিকিৎসকদের নির্ধারিত সময়ে বহির্বিভাগে বসতে হবে। তবে বিকেলের আউটডোর চালু হলে চাপ অনেকটাই কমে যাবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুহাম্মদ আব্দুস সবুর বলেন, 'ডাক্তাররা বলছেন আমরা অতিরিক্ত প্রেশারে আছি রোগীদের সময় দিতে পারছি না। তার কারণ সকাল ৮টা থেকে আড়াইটার সময় চলে এসেছে ১১টা থেকে দেড়টা এতে রোগীর সমস্যা ঠিক মতো শুনেন না। ডাক্তারদের কাজ শুধু প্রেসক্রিপশন লেখা না।'
দিনে দিনে রোগীর সংখ্যা বাড়লেও পর্যাপ্ত জনবল কখনোই পায়নি সরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগ। এতে কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হন দূর দূরান্ত থেকে আসা রোগীরা। তবে জনবল সংকটের কথা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ স্বীকার করলেও জনবল বাড়াতে স্বাস্থ্য বিভাগের দেখা যায় নি কোনো ভূমিকা।