এখানে বিদ্যুৎ বিল কমানোর কিছু সহজ ও কার্যকর এবং তথ্যবহুল কৌশল দেওয়া হলো:
১. তাপ নিয়ন্ত্রণ এবং কাঠামোমূলক পরিবর্তন (Thermal Control & Structural Adjustments)
- জানালায় সঠিক ব্যবহার: গরমের দিনে সরাসরি সূর্যের আলো ঘরে প্রবেশ আটকাতে দিনের বেলায় পর্দা বা ব্লাইন্ডস (Curtains or Blinds) টেনে রাখুন। এতে ঘর প্রাকৃতিকভাবে শীতল থাকবে এবং এসি কম চালাতে হবে।
- সিলিং ফ্যান স্মার্টলি ব্যবহার: এসি চালানোর সময়ও সিলিং ফ্যান (Ceiling Fan) ব্যবহার করুন। ফ্যানের বাতাস ঠান্ডা বাতাসকে পুরো ঘরে সঞ্চালিত করে, ফলে আপনি এসি'র তাপমাত্রা ২ থেকে ৩ ডিগ্রি বাড়িয়ে দিতে পারেন, যা সরাসরি বিদ্যুৎ সাশ্রয় করবে।
- বায়ু চলাচল নিশ্চিত করুন: ফ্রিজ, রেফ্রিজারেটর বা ডিপ ফ্রিজ (Deep Freeze) দেয়াল থেকে অন্তত ৬ ইঞ্চি দূরে রাখুন, যাতে মেশিনের পেছনের গরম বাতাস সহজে বেরিয়ে যেতে পারে। তাপ আটকে থাকলে কম্প্রেশরকে বেশি কাজ করতে হয়।
- ফ্যানের রেগুলেটর: অনেকের ধারণা, ফ্যানের রেগুলেটর কমালে বিদ্যুৎ খরচে কোন পরিবর্তন হয় না। এটি একদমই ভুল ধারণা। মূলত আধুনিক প্রযুক্তির ইলেকট্রনিক্স রেগুলেটর ব্যবহার করলে বিদ্যুৎ খরচ কম হয়। এ জন্য প্রয়োজন না হলে রেগুলেটর থেকে কমিয়ে ফ্যান ব্যবহার করুন।
২. প্রধান যন্ত্রপাতির কার্যকারিতা ও ব্যবহার (Efficiency of Major Appliances)
আপনার বাড়ির সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী যন্ত্রগুলির ক্ষেত্রে বিশেষ যত্ন নিন:
- এসি তাপমাত্রা (AC Temperature): গ্রীষ্মকালে এসি'র থার্মোস্ট্যাট ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস (24°C)-এ সেট করুন। এটি মানব শরীরের জন্য আরামদায়ক আদর্শ তাপমাত্রা। মনে রাখবেন, তাপমাত্রা এর নিচে নামালে প্রতি ডিগ্রি কমানোর জন্য বিদ্যুতের ব্যবহার ৫% থেকে ৮% পর্যন্ত বেড়ে যায়। ইনভার্টার এসি (Inverter AC) সাধারণ এসির চেয়ে অনেক বেশি সাশ্রয়ী, কারণ এটি কুলিং লোড অনুযায়ী শক্তি ব্যবহার করে।
- ফ্রিজের যত্ন (Fridge Care): ফ্রিজ বা ডিপ ফ্রিজ (Deep Freeze) সব সময় দেয়াল থেকে কিছুটা দূরে রাখুন, যাতে পেছনে বাতাস চলাচলের সুযোগ থাকে। গরম খাবার সরাসরি ফ্রিজে রাখবেন না। আর ফ্রিজের দরজা বারবার খোলা বা বেশিক্ষণ খোলা রাখা থেকে বিরত থাকুন—এতে বিদ্যুৎ খরচ বাড়ে।
- ফ্রিজার ডিফ্রস্ট রাখুন : যদি আপনার ফ্রিজে প্রচুর পরিমাণে বরফ জমে থাকে, তবে এই বরফের কারণে ফ্রিজের ঠান্ডা হওয়ার ক্ষমতা কমে যায় ও এটি বেশি পরিমাণে বিদ্যুৎ খরচ করে। তাই, সবসময় ফ্রিজকে ডিফ্রোস্ট করে রাখুন এবং গরম খাবারকে একটু ঠাণ্ডা হওয়ার পরই ফ্রিজে রাখুন। এতে বিদ্যুৎ বিল কম খরচ হবে।
- গিজার বা ওয়াটার হিটার (Water Heater/Geyser): এটি একটি উচ্চ বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী যন্ত্র। শুধুমাত্র প্রয়োজনমতো ব্যবহার করুন এবং ব্যবহারের ১৫-২০ মিনিট আগে চালু করুন। যদি থার্মোস্ট্যাট সেটিং থাকে, তবে এটি খুব বেশি গরম না করে মাঝারি তাপমাত্রায় সেট করুন।
- আয়রন ও ওয়াশিং মেশিন: কম বিদ্যুৎ ব্যবহারের সময়, যেমন দিনের বেলায় বা একসঙ্গে অনেক কাপড় ইস্ত্রি করুন। ওয়াশিং মেশিনে গরম পানি (Hot Water) ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন, কারণ এটি অনেক বেশি শক্তি টানে।
৩. আলো ও ছোট ডিভাইসের স্মার্ট ব্যবহার (Smart Use of Lights and Devices)
- LED-তে স্থানান্তর (Switch to LED): আপনার বাড়িতে এখনো যদি পুরানো ফিলামেন্ট বা CFL বাল্ব থাকে, তবে দ্রুত তা এলইডি লাইট (LED Light) দিয়ে প্রতিস্থাপন করুন। LED লাইট ৭০-৮০% কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করে এবং এদের স্থায়িত্বও অনেক বেশি।
- অফ করুন অভ্যাসে: ঘর থেকে বের হওয়ার সময় বা দিনের আলো যখন যথেষ্ট, তখন অযথা আলো জ্বালিয়ে রাখবেন না। এটিই বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের (Power Saving) সবচেয়ে প্রাথমিক এবং গুরুত্বপূর্ণ উপায়।
- স্ট্যান্ডবাই মোড বন্ধ (Turn off Standby): টিভি, সেট-টপ বক্স, গেমিং কনসোল এবং কম্পিউটারগুলিকে স্ট্যান্ডবাই মোডে (Standby Mode) ফেলে রাখবেন না। এই ডিভাইসগুলি বন্ধ থাকা সত্ত্বেও বিদ্যুৎ টানে। এটিকে 'ভূতুড়ে বিদ্যুৎ' (Phantom Power) বা 'লীকেজ' বলা হয়।
- আনপ্লাগ অভ্যাসে আনুন: ফোন চার্জার (Phone Charger) বা ল্যাপটপ অ্যাডাপ্টার চার্জিং শেষে অবশ্যই সকেট থেকে খুলে রাখুন। অব্যবহৃত থাকাকালীনও এরা বিদ্যুৎ শোষণ করে।
বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের ঘরোয়া টোটকা |ছবি : সংগৃহীত
৪. সাধারণ অভ্যাস ও রক্ষণাবেক্ষণ (General Habits and Maintenance)
- ধুলো পরিষ্কার: সিলিং ফ্যান, এসি ফিল্টার, এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক গ্যাজেট নিয়মিত পরিষ্কার রাখুন। ধুলো জমে থাকলে যন্ত্রের দক্ষতা কমে যায় এবং বিদ্যুৎ বেশি খরচ হয়।
- দিনের আলো কাজে লাগানো: দিনের বেলায় পর্দা সরিয়ে প্রাকৃতিক আলো ব্যবহার করুন। এতে শুধুমাত্র বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে না, আপনার মেজাজও ভালো থাকবে।
- সার্টিফাইড যন্ত্রপাতি: যখনই কোনো নতুন ইলেকট্রনিক পণ্য কিনবেন, তখন তার এনার্জি রেটিং (Energy Rating) দেখে কিনুন। উচ্চ স্টার রেটিং মানে কম বিদ্যুৎ খরচ।
৫. রান্নাঘরের কৌশল (Kitchen Strategies)
রান্নাঘরের যন্ত্রপাতির সঠিক ব্যবহারও বিল কমাতে পারে:
- মাইক্রোওয়েভ বনাম ওভেন: ছোটখাটো খাবার গরম করার জন্য বড় ওভেনের (Oven) চেয়ে মাইক্রোওয়েভ ওভেন (Microwave Oven) ব্যবহার করুন। মাইক্রোওয়েভ অনেক কম শক্তি ব্যবহার করে।
- হট প্লেটের ব্যবহার: রান্নার পাত্র হট প্লেট বা ইন্ডাকশন কুকারের (Induction Cooker) আকারের সমান বা তার চেয়ে বড় হওয়া উচিত, যাতে তাপ নষ্ট না হয়।
- ফ্রিজের তাপমাত্রা: ফ্রিজের তাপমাত্রা আদর্শভাবে ৩°C থেকে ৪°C এবং ডিপ ফ্রিজের তাপমাত্রা -১৮°C থেকে -২০°C-এর মধ্যে সেট করুন। এর নিচে নামালে অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ খরচ বাড়বে।
এই সহজ এবং ঘরোয়া টিপস (Domestic Tips) গুলি আপনার দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করলে, আপনার মাসিক বিদ্যুৎ বিল কমানো (Monthly Electricity Bill Reduction) সম্ভব হবে এবং আপনি সাশ্রয় করা অর্থ অন্য কাজে ব্যবহার করতে পারবেন।





