সবচেয়ে গুরুতর যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা! আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে দক্ষিণ আফ্রিকা মামলা করার পরও গাজায় চালানো সেই গণহত্যা থেকে ইসরাইলকে পিছু হটানো সম্ভব হয়নি। প্রথমবারের ইসরাইলকে দায়ী করে প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের নিযুক্ত তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন। গণহত্যায় প্ররোচনার জন্য ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু, প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হার্জোগ এবং সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টকে অভিযুক্তও করা হয়েছে। তবে জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদনের অভিযোগুলো প্রত্যাখ্যান করেছে ইসরাইল।
এখন প্রশ্ন হলে, গণহত্যা আসলে কী? গুরুতর এ যুদ্ধাপরাধ প্রমাণইবা করা হয় কীভাবে? এক্ষেত্রে দেখা গেছে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের গৃহীত কনভেনশনে গণহত্যাকে একটি জাতীয়, জাতিগত, বর্ণগত বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে সংঘটিত অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। সে হিসেবে দিনের পর দিন এসব অপরাধ প্রকাশ্যেই করে যাচ্ছে ইসরাইল। যার সাক্ষী পুরো বিশ্ববাসী। তবুও আদালতে এসব অপরাধ প্রমাণ করা অত্যন্ত কঠিন বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
যুক্তরাজ্যের লন্ডনের আইন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক দেভিকা হোভেল বলেন, ‘আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আইনে গণহত্যা প্রমাণ করা সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর মধ্যে একটি। প্রসিকিউটরদের কেবল এটিই দেখালে চলবে না যে, এমন কিছু ঘটেছে- যা গণহত্যা, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি, অনাহার ইত্যাদি। বরং এগুলো একটি সুরক্ষিত গোষ্ঠীকে ধ্বংস করার নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে পরিচালিত হয়েছে তাও প্রমাণের বিধান রয়েছে।’
এখন পর্যন্ত তিনটি গণহত্যা মামলার রায় দিয়েছেন আন্তর্জাতিক বিচার আদালত। এর মধ্যে রয়েছে ১৯৭০-এর দশকে কম্বোডিয়ান খেমার রুজ কর্তৃক সংখ্যালঘু চাম এবং ভিয়েতনামিসহ আনুমানিক ১৭ লাখ মানুষকে হত্যার ঘটনা। যে মামলায় বছরের পর বছর বিতর্কের পর ২০১৮ সালে কম্বোডিয়ার খেমার রুজের দুই নেতাকে গণহত্যার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এছাড়া ১৯৯৫ সালে বসনিয়ায় স্রেব্রেনিকা গণহত্যার রায় হয়েছে ২০০৭ সালে। আর ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় তুতসিদের গণহত্যা রায়ে বড় অবদান ছিলো রুয়ান্ডা ট্রাইব্যুনালের। এসব রায় নজির সৃষ্টি করেছে যে, গণহত্যার বিচার নিশ্চিতে যৌথভাবে এগিয়ে যেতে হয় ভুক্তভোগী রাষ্ট্র ও জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে।
আরও পড়ুন:
অধ্যাপক দেভিকা হোভেল বলেন, ‘এখন পর্যন্ত প্রমাণিত ফলাফলগুলো আন্তর্জাতিক আদালত এবং ট্রাইব্যুনালের যৌথ এখতিয়ারের মাধ্যমে জাতীয় আদালত থেকেই এসেছে। যেমন রুয়ান্ডা ট্রাইব্যুনাল ৬১জনকে দোষী সাব্যস্ত করেছে, যার মধ্যে অনেকগুলো গণহত্যার জন্য। আর স্রেব্রেনিকা গণহত্যায় ভূমিকার জন্য বেশ কয়েকজনকে দোষী সাব্যস্ত করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আট হাজারেরও বেশি বসনিয়ান মুসলিম পুরুষ এবং ছেলেকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ায় ওই রায় দেয়া হয়েছিলো। ২০০৭ সালে সেই রায়ে আইসিজে উল্লেখ করেছিলো, সার্বিয়া সরাসরি দায়ী না হলেও গণহত্যা প্রতিরোধে করতে ব্যর্থ হয়েছে।’
এসব দিক বিবেচনায় গাজায় গণহত্যা ইস্যুতে প্রথমবারের মতো ইসরাইলের বিরুদ্ধে আনা জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
অধ্যাপক দেভিকা হোভেল বলেন, ‘জাতিসংঘের প্রতিবেদনটি আইনত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রথমবারের মতো কোনও স্বাধীন সংস্থা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে ইসরাইল গণহত্যা করছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, জনসাধারণের বিবৃতি এবং সামরিক অভিযান থেকে প্রাপ্ত পরিস্থিতিগত প্রমাণের ভিত্তিতে এই তদন্ত প্রতিবেদন করা হয়েছে। তাই আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, এটি বিচারিক রায় না হলেও অনেক গুরুত্ব রয়েছে। এটি আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে চলমান কার্যক্রম এগিয়ে নিতে অনেক বড় ভূমিকা রাখবে।’
বর্তমানে গাজায় গণহত্যার জন্য ইসরাইলের বিরুদ্ধে ছাড়াও মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যার জন্য জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার করা মামলা এবং দারফুরে গণহত্যা চালানোর অভিযোগে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিরুদ্ধে সুদানের করা মামলা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে চলমান। গণহত্যার বিচারের জন্য প্রসিকিউটরদের প্রথমে দেখাতে হবে যে, ভুক্তভোগীরা একটি স্বতন্ত্র জাতীয়, জাতিগত, বর্ণগত বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর অংশ ছিলেন। এই বিচারকার্যে রাজনৈতিক বিশ্বাসের জন্য লক্ষ্যবস্তু গোষ্ঠীগুলো প্রাধান্য দেয়া হয় না।





