চলতি সপ্তাহে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি কূটনৈতিক আয়োজন হয় তুরস্কে। ইউক্রেন - রাশিয়া যুদ্ধবিরতি আলোচনা, ইরান–যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু আলোচনা এবং ন্যাটো পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন। এতো গুরুত্বপূর্ণ উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক তুরস্কেই হওয়ার বিষয়টি কাকতালীয় নয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, তুরস্ক এখন দৃঢ় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন ইস্যুতে জায়গা করে নিয়েছে।
গেল কয়েক দশক ধরে তুরস্ক দাঁড়িপাল্লায় নিত্যপণ্য মাপার মতো করেই ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে পূর্ব আর পশ্চিমে। ভৌগোলিক আর রাজনৈতিক অবস্থান থেকে কাজ করছে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে। এক সপ্তাহে তিনটি কূটনৈতিক বৈঠক প্রমাণ করে, আঙ্কারার ভৌগোলিক গুরুত্ব। বিশ্বব্যাপী এই দেশ পরিচিতি পেয়েছে আস্থার প্রতীক হিসেবে।
সংবাদমাধ্যম টিআরটি'র বিশ্লেষণ বলছে, মূলত করোনা মহামারির সময় থেকে দেশে দেশে এই আস্থা তৈরি করেছে তুরস্ক। সেই সংকটের সময় দেশে দেশে চিকিৎসাসেবা সামগ্রী পাঠিয়েছে আঙ্কারা। দেশের পররাষ্ট্র নীতির মূলস্তম্ভে পরিণত হয় সংকটের সময় প্রতিবেশীসহ বিশ্বের যেকোনো দেশকে সহযোগিতা করার বিষয়টি।
যা আরও প্রকাশ পায় ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের সময়। সেসময় গম সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে মধ্যস্থতা করে আঙ্কারা। গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনের মধ্যে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতেও তৎপরতা চালায় তুরস্ক। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গাজার পক্ষে দাঁড়ায় আঙ্কারা। একই কূটনীতি তুরস্ক অব্যাহত রাখে সিরিয়া, লিবিয়া, কারাবাখ সংকটেও। এমন করেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাড়ছে তুরস্কের প্রভাব, আন্তর্জাতিক বৈরিতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশের শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতি।
চলতি সপ্তাহে ইউক্রেন-রাশিয়া বৈঠক প্রমাণ করে, এমন এক সংঘাতের সমাধানে মধ্যস্থতার চেষ্টা করছে তুরস্কে, যেই সংকটের ৩ বছর ধরে কোন সুরাহা হচ্ছে না। কিয়েভ-মস্কো, দুই পক্ষের সঙ্গেই আলোচনা অব্যাহত রেখেছে আঙ্কারা যুদ্ধের শুরু থেকেই। ন্যাটো সদস্য দেশগুলোর মধ্যে শুধু তুরস্কের যোগাযোগ আছে ক্রেমলিনের সাথে। বিশ্লেষকরা বলছেন, তুরস্কের কূটনীতি দৃশ্যমান সিরিয়া থেকে কারাবাখ, লিবিয়া থেকে পূর্ব ভূমধ্যসাগর, রাশিয়া থেকে ইউক্রেন এমনকি ফিলিস্তিনে ইসরাইলের আগ্রাসন ইস্যুতেও।
শুরু থেকেই তুরস্ক খোলাখুলি আলোচনা, স্বচ্ছ আর দায়িত্বশীল অবস্থান ধরে রাখায় সব দেশই দিয়েছে ইতিবাচক সাড়া। তুরস্কের মধ্যস্থতায় ছিল না দরজার পেছনের রাজনীতি কিংবা গোপন কোন আলোচ্যসূচি। যে কারণে বিশ্বের বহুমুখী সংকটে তুরস্ক অর্জন করেছে বিশ্বস্ততা। যদি ইউক্রেনে ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়, ২০২২ সালের শস্য চুক্তির পর এটাই হবে তুরস্কের সবচেয়ে যুগান্তকারী অর্জন।
ন্যাটোর সঙ্গে নানা ইস্যুতে টানাপড়েন থাকলেও আন্তালিয়ায় চলতি সপ্তাহে আয়োজিত ন্যাটো পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন প্রমাণ করে, উত্তর আটলান্টিক প্রতিরক্ষা জোটেও আঙ্কারার প্রভাব চোখে পড়ার মতোই। কারণ একদিকে ন্যাটো সদস্য দেশ, অন্যদিকে, রাশিয়া, ইরান আর চীনের সঙ্গেও কূটনৈতিক সম্পর্ক ইতিবাচক তুরস্কের।
যুক্তরাষ্ট্র-ইরান পরমাণু আলোচনাও আঙ্কারার বড় অর্জন। যেখানে ওয়াশিংটন - তেহরান কিংবা ইরান – ইসরাইল এক টেবিলে বসতেই নারাজ, সেখানে তাদের মধ্যে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে তুরস্ক। এখানে রয়েছে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপ এরদোয়ানের নিজের স্বার্থও। ইরান, সিরিয়া, ইরাক তিন দেশই তুরস্কের প্রতিবেশী কিন্তু সংঘাতের হটস্পট। এই অঞ্চলে শান্তি বজায় রাখা তুরস্কের নিরাপত্তা আর অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য জরুরি।
কিন্তু কেন কূটনৈতিকভাবে এতো তৎপর তুরস্ক? বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইরাকে সেনা অভিযান আর আরব বসন্তের পর তুরস্কের সীমান্তগুলো অনিরাপদ হয়ে যায়। আশপাশের অঞ্চল, মধ্যপ্রাচ্য এমনকি পুরো বিশ্বে সংঘাত কমিয়ে আনতেই কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে আঙ্কারা।
বিশ্বের বিভিন্ন সংকটে তুরস্কের মধ্যস্থতার পাশাপাশি দেশটির অর্থনৈতিক, সামরিক আর কূটনৈতিক সক্ষমতার কারণে ক্রমশ সুপার পাওয়ার হচ্ছে আঙ্কারা। কূটনীতিতে তুরস্কের অবস্থান তাই অস্বীকার করার কোন উপায় নেই বলেও মত বিশ্লেষকদের।