ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দেবে, শুধু এই এক কথার ওপর চড়াও হয়ে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে কোন প্রস্তুতি ছাড়াই ইউক্রেনে সেনা অভিযান শুরু করে দেয় রাশিয়া। সেই থেকে এখন পর্যন্ত একপ্রকার অপ্রতিরোধ্যভাবেই চলছে এই সেনা অভিযান। দীর্ঘ সময় ধরে এই যুদ্ধ পরিচালনা করতে গিয়ে সেনা সংকটে পড়লেও, অস্ত্র সংকটে পড়তে হয়েছে রাশিয়াকে, এই তথ্য কোথাও পাওয়া যায়নি। তবে, টানা তিন বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে রাশিয়াকে এই বিপুল পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করছে কারা?
এ বিষয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। যেখানে বলা হয়েছে, রাশিয়ার ওয়ার মেশিন এতোদিন ধরে সচল রেখেছে দেশটির ধনকুবেররাই।
মানুষের ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন রাসায়নিক তৈরির আড়ালে রাশিয়ার অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য তৈরি হচ্ছে হাজার হাজার টন রাসায়নিক। আর এই কেমিক্যাল দিয়েই অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি করছে বিস্ফোরক, যা ব্যবহৃত হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্রে।
রয়টার্স এমন পাঁচটি রাসায়নিক কোম্পানি শনাক্ত করেছে, যেগুলোর মালিকানায় রয়েছেন পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা ৫ ধনকুবের। এই কোম্পানিগুলো ৭৫ শতাংশের বেশি রাসায়নিক রেলপথে রাশিয়ার বৃহত্তম কয়েকটি বিস্ফোরক তৈরির কারখানায় সরবরাহ করছে যুদ্ধের শুরু থেকেই। বিশ্লেষণ বলছে, যুদ্ধের মেশিন এভাবেই ব্যক্তি আর প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ভর করে চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া।
এই ধনকুবেরদের মধে রয়েছে সাবেক চেলসি ফুটবল ক্লাব মালিক রোমান আব্রামোবিচ। রয়েছেন ভাগিত আলেকপেরোভ, যিনি চলতি বছরের এপ্রিলেই ফোর্বসের বিলিওনেয়ার তালিকায় ছিলেন, তার মোট সম্পদ ছিলো ২ হাজার ৮৬০ কোটি ডলার। যদিও আব্রামোবিচ আর আলেকপেরোভ এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
লন্ডনের তালিকাভুক্ত এভরাজ, যেখানে আব্রামোবিচের ২৮ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানও জানিয়েছে, তারা এমন রাসায়নিক তৈরি করে, যেগুলো সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে। আরেক রিফাইনারি লুকোইল, যেখানে আলেকপেরোভের শেয়ার রয়েছে। তাদেরও দাবি, কোন ধরনের বিস্ফোরক উপকরণ তৈরি করে না তারা।
গবেষকরা বলছেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে সাপ্লাই চেইন নেটওয়ার্ক বেশ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, এই পাঁচ কোম্পানি শুধু যে অস্ত্র তৈরির প্রয়োজনীয় বিস্ফোরক রাসায়নিক সরবরাহ করছে তা নয়।
সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে এমন সব রাসায়নিক বিক্রি করে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে তারা, বিক্রি করছে সারও। অন্য সব কোম্পানির মতো তারা সাধারণ মানুষের প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করছে। খালি চোখে এমন মনে হলেও বাস্তবে তাদের মূল ব্যবসা যুদ্ধক্ষেত্রে।
রাশিয়ার সামরিক বাহিনী কোথা থেকে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র তৈরির উপকরণ পায়, তা খতিয়ে দেখেছে রয়টার্স। দেখা যায়, ৬ লাখের বেশি রেল শিপমেন্ট গেছে, যেখানে বিস্ফোরক কেমিক্যাল ছিলো, যা দিয়ে ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর জন্য অস্ত্র বানিয়েছে মস্কো।
ডেটাবেজের তথ্য বিশ্লেষণ করে রয়টার্স আরও জানায়, বিলিওনেয়ারদের কোম্পানিগুলো থেকে রাশিয়ার বিস্ফোরক তৈরির ৫ কারখানায় গেছে বিভিন্ন উপকরণ। এ বিষয়ে ক্রেমলিন কিংবা রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় কেউই মুখ খোলেনি।
ন্যাটো আর ইউক্রেনের আর্টিলারি সংকট এমনিতেই ২০২৪ সালে রাশিয়ার জন্য বড় অর্জন হয়ে এসেছে। মস্কো সামরিক খাতে অনেক বেশি বিনিয়োগ করছে, আর অস্ত্রের মজুত বাড়াচ্ছে। ২০২৪ সালে উত্তর কোরিয়া থেকেও ২৪ লাখ আর্টিলারি শে তৈরি হয়েছে আর ৩০ লাখ আমদানি হয়েছে উত্তর কোরিয়া থেকে।
আর্টিলারি আর ক্ষেপণাস্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় বিস্ফোরক এইচএমএক্স আর আরডিএক্স পাঁচ কোম্পানিতে সরবরাহের অভিযোগ রয়েছে স্ভার্দলভ কারখানার বিরুদ্ধে। রুশ ধনকুবের আন্দ্রে মেলনিশেনকো'র বিরুদ্ধে অভিযোগ, স্ভার্দলভে রাসায়নিক সরবরাহ করে তার কোম্পানি ইউরোকেম।
এই ইউরোকেম প্রথমে স্ভার্দলভে ৩৮ হাজার মেট্রিক টন এসেটিক অ্যাসিড পাঠিয়েছে, এরপর পাঠিয়েছে ৫ হাজার মেট্রিক টন নাইট্রিক অ্যাসিড। এই এসিডগুলো ব্যবহৃত হয় বিস্ফোরক এইচএমএক্স আর আরডিএক্স তৈরিতে।
রয়টার্সের হিসাব বলছে, ৫ হাজার টন নাইট্রিক এসিড দিয়ে ৩ হাজার টন আরডিএক্স তৈরি সম্ভব, যা দিয়ে ৫ লাখ আর্টিলারি শেল পূর্ণ করা সম্ভব। ফোর্বসের বিলিওনেয়ার তালিকা অনুযায়ী, আন্দ্রে মেলনিশেনকোর মোট সম্পদের পরিমাণ ১ হাজার ৭৫০ কোটি ডলার।
আরেক সার তৈরির কারখানা উরালকেমের মালিক বিলিওনেয়ার দিমিত্রি মাজেপিন। স্ভার্দলভে তারা সরবরাহ করেছে, ২৭ হাজার টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট। এই রাসায়নিকও এইচএমএক্স, আরডিএক্স আর টিএনটি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
যুদ্ধের আগে এসব কোম্পানিগুলো গান পাউডার আর বিস্ফোরক তৈরি করতো সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য। বিশ্লেষকরা বলছেন, সাধারণ কাঁচামাল অনেক কাজেই ব্যবহার করা যায়, কিন্তু কয়েকটি রাসায়নিক একীভূত করলে তৈরি হয় ভয়াবহ বিস্ফোরক।
কোটিপতিরা নিষেধাজ্ঞার আওতায় এলেও নিজেদের লাভের চিন্তা করে পশ্চিমারা রাসায়নিক কারখানাগুলোকে নিষেধাজ্ঞার বাইরে রেখেছে। কারণ প্রতিষ্ঠানগুলো আবার জরুরি পণ্য আমদানি করে যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে।
সেক্ষেত্রে ইউক্রেনে আগ্রাসন চালিয়ে যেতে রাশিয়াকে পশ্চিমারাই ঘুরে ফিরে সহযোগিতা করছে কিনা, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। যেহেতু কোম্পানিগুলো সারও সরবরাহ করে, তাই দুর্ভিক্ষ এড়াতে এই কোম্পানিগুলোর ওপর কোন নিষেধাজ্ঞা দেয়নি পশ্চিমারা।