এবারের বৈশাখি রোদ সইতে পারছে না প্রকৃতি ও মানুষ। সূর্যের তাপ ও উষ্ণ হাওয়ায় গ্রাম-শহরের মানুষ শুষ্ক প্রানে প্রশান্তি আনতে, চুমুক দেন শরবত নামের শীতল পানীয়তে। ঘরে তৈরির পাশাপাশি, রাস্তার শরবত পান করেন পথচারী ও শ্রমজীবীরা। পথে সহজলভ্য আখের রস, লেবুর শরবত, রঙ বেরঙের গুঁড়া মিশ্রিত কোমল পানীয়, ফলজ, লাচ্ছি-মাঠাসহ হরেক নামের ড্রিংকস। নিরাপদ উপায়ে তৈরি না হওয়া এসব পানীয়তে রয়েছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি।
এতে তৃষ্ণা মেটাতে গিয়ে স্বস্তির বদলে বাসা বাঁধে অসুখ, ফলে হারাতে হয় কর্মক্ষমতা। এতে করে একাধিক দিনের করা বেশি উপার্জন চলে যায় একদিনের অসুখেই।
শ্রমজীবীরা বলেন, গরমে শরবত অনেকবার খাওয়া হয়। শরবত খাওয়ার পর শান্তি লাগে। রোদে কষ্ট করার পর এটা না খাইলে হয় না। অনেক সময় পরিবারের জন্যও নিয়ে যাই। অনেক সময় শরীর খারাপ করে, পেট খারাপ হয়।
বিক্রেতারা বলছেন এসব তৈরির প্রক্রিয়ায় ভিন্নতা রয়েছে। তীব্র গরমে ঠাণ্ডা জলে হাত দীর্ঘসময় বরফে ডুবে থাকায় অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তবে হাতমোজা পরে কাজ করলে ক্রেতারা খেতে চায় না বলে অভিযোগ করছেন তারা।
তারা বলেন, চিনি-দুধ-মধু দিয়ে তৈরি করি। আবার ইসবগুলের ভুসি, আপেল ও আনারস দেই। গ্লাভস না লাগালেও তারা খাবে। কারণ এখন তো আর করোনা নাই। আবার অনেক সময় গ্লাভস পড়া থাকলে কাস্টমার খায় না।
স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণাপত্রে এ নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা পাওয়া যায়নি। এখন টেলিভিশন পথে তৈরি ফলজ ও রকমারি শরবতের নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণাগারে পরীক্ষা করার উদ্যোগ নেয়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের গবেষকদের হাতে তুলে দেয়া হয় ৫টি নমুনা। মাইক্রোবায়োলজিষ্ট অধ্যাপক ড. শামীমা বেগম ও মাইক্রোবায়োলজিস্ট ড. আবুল কালাম আজাদের যৌথ দল এই পরীক্ষা করে।
প্রথমে নমুনা প্রস্তুতপর্বে কালচার মিডিয়া, কালচার প্লেট, বিভিন্ন ধরনের সল্যুশন ও প্রয়োজনীয় আনুষাঙ্গিক বিষয়সমূহকে অটোক্লেভ মেশিনের মধ্যমে জীবাণুমুক্ত করা হয়। প্রাপ্ত নমুনা সমূহকে ল্যামিনার এয়ারফ্লোতে প্রক্রিয়াজাত করে সিরিয়াল ডায়ল্যুশন প্রক্রিয়াকে অনুসরণ করা হয় কোয়ান্টিটিভ এ্যানালাইসিসের জন্য।
এরপর নমুনাগুলোকে ল্যামিনার এয়ারফ্লোই ইনোকুলেশন করা হয়। নমুনাগুলো বের করে কলোনি কাউন্টারের মাধ্যমে পার মিলিলিটার জুসে ব্যাকটেরিয়াল উপস্থিতি গণনা করা হয়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় অনুজীববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদ বলেন, 'লেমন জুস ও সফট ড্রিংকে টোটাল কাউন্ট কম এসেছে। আর বাকিগুলোতে ব্যাকটেরিয়া উপস্থিতি পাওয়া গেছে মাত্রাতিরিক্ত।'
অর্থাৎ গাল্ফ স্ট্যান্ডার্ড অনুসারে কলোনি ফর্মিং ইউনিট বা সিএফইউ সর্বোচ্চ ৫ ইন্টু ১০ টু দি পাওযার থ্রি থাকা চলে আর করিফর্মের সংখ্যা ১০ সেখানে ৫টি নমুনার মধ্যে সিএফইউ দুটি নমুনা লিমিটের মধ্যে আর ৪টি নমুনায় পাওয়া গেছে মাত্রাতিরিক্ত কলিফর্ম। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে লেবুর রসে সাইট্রিক এ্যাসিড থাকায় পিএইচ কমে ব্যাকটেরিয়া বাড়তে পারে না। আর সফট ড্রিংক পাওডার শুষ্ক ও বরফের ঠাণ্ডা পানিতে কলিফর্ম বাড়তে কম পারে। এরপরও পাওয়া গেছে মাত্রাতিরিক্ত কলিফর্ম।
প্রাপ্ত নমুনায় পরবর্তীতে প্যাথজেনেটিক ব্যাকটেরিয়া সিলেকটিভ মিডিয়ার মাধ্যমে আলাদা করে পাওয়া গেছে ই কোলাই, ভিবরিও কলেরা, স্টেফাইলোকক্কাস, শিগেলা, সালমোনেলার মতো ব্যাকটেরিয়া যা অধিকাংশই মলের জীবাণুতে থাকে। এসব পানের মাধ্যমে ডায়রিয়া, আমাশয়, কলেরা, টাইফয়েড, হেপাটাইসিস, ফুডপয়জনিং, মূত্রনালীর সংক্রমণসহ মারাত্মক ক্ষতিকর রোগ সৃষ্টি করে।
অনুজীব বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ থেকে রেহায় পেতে দরকার সচেতনতা, ভেন্টরদের প্রশিক্ষণ, সরকারি প্রতিষ্ঠানের তদারকি, ফুডকোর্টে নিরাপদ উপকরণ ও জায়গাসহ এ কাজে নিয়মিত গবেষণায় সম্পৃক্ত করা।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় অনুজীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শামীমা বেগম বলেন, 'শরবত তৈরিতে চামচ-ছুরি ব্যবহারে তাদেরকে সচেতন হতে হবে। কারণ এগুলো শোয়াচে রোগ। পরিবারের একজন আক্রান্ত হলে বাকিরাও আক্রান্ত হতে পারে।'
রাস্তার পাশের ভ্রাম্যমাণ শরবতের দোকান নিয়ে গবেষণায় উঠে এসেছে ভয়ংকর রকমের তথ্য। অনুজীব বিজ্ঞানীরা বলছেন ব্যক্তিগত সচেতনতা ও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা মাধ্যমে এর সমাধান করা সম্ভব।