বিভিন্ন সময়ে দেয়া কোম্পানির আইপিও আবেদন, খসড়া প্রসপেক্টাস, তথ্য, সংবেদনশীল তথ্য, ডিএসইর পর্যবেক্ষণ এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক নথি ও ব্যাখ্যা যাচাই করে বেশকিছু অসঙ্গতি পাওয়ার কথা জানিয়ে বিএসইসির চিঠিতে বলা হয়েছে যে, কোম্পানিটি আবাসনে তার বিনিয়োগের সম্পদের মূল্য জানিয়েছে ৭০০ কোটি টাকা। সেই সাথে ৩০ জুন ২০২৩ শেষে কর পরবর্তী মুনাফা হয়েছে ৬৫২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। কিন্তু আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী আবাসনে বিনিয়োগ করলে কাজ শেষ হওয়ার পর থেকে সেই বিনিয়োগের লাভ বা লস হিসাব করতে হবে। তবে ৭০০ কোটি টাকায় যে মুনাফা দেখানো হয়েছে তা অবাস্তব প্রমাণ করে।
সম্পদ মূল্যের বিষয়ে বলা হয়েছে, কোম্পানির সম্পদ মূল্য ২০২২ সালের ৩০ জুন ছিল ৮১ টাকা ৩৭ পয়সা। যা বেড়ে ২০২৩ সালের ৩০ জুন ১৪৮ টাকা ৫৪ পয়সা হয়েছে। অথচ ন্যায্য মূল্য ও আসল মূল্যের লাভ বাদ দিলে সম্পদ মূল্য হত ৮৫ টাকা ২০ পয়সা। তাই এ অতিমূল্যায়িত সম্পদ মূল্যের বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিএসইসি। সেই সাথে এই মূল্যে তালিকাভুক্ত হলে বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং কোম্পানি তার আর্থিক অবস্থান ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে বলে জানায়।
লভ্যাংশের বিষয়ে বলা হয়েছে, কোম্পানিটি ২০২৩ সালের ৩০ জুন শেষে আনরিয়ালাইজড মুনাফা কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দেখিয়েছে। ফলে গুরুত্বপূর্ণভাবে প্রকৃত নগদ অর্থ প্রবাহ না থাকায় লভ্যাংশ দিতে পারবে না। তাই লভ্যাংশ দিতে গেলে কোম্পানির এই অবাস্তব মুনাফা কোনো কাজে আসবে না।
আয়ে অসঙ্গতির বিষয়ে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের ৩০ জুন কোম্পানির শেয়ার প্রতি মুনাফা ছিল ২ টাকা ৯৯ পয়সা। যা ২০২৩ সালের ৩০ জুন শেষে ৬৫ টাকা ২৫ পয়সা দেখানো হয়েছে। ৭০০ কোটি টাকা বাদ দিলে তা হবে মাত্র চার টাকা ৬৪ পয়সা। যা কোম্পানি অসত্য তথ্য প্রদান করেছে এবং তালিকাভুক্তির পর বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি করেছে বলে জানায় বিএসইসি।
এছাড়া কোম্পানি ২০২৩ সালের ৩০ জুন যে আর্থিক তথ্য প্রদান করেছে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে এবং কোম্পানি অসৎ উদ্দেশ্যও থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে চিঠিতে।
দ্বিতীয়ত বলা হয়েছে, মো. নূর আলী বোরাক রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হয়েও ডিএসইতে তালিকাভুক্ত ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস এবং অন্যান্য অতালিকাভুক্ত আট কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ফলে তিনি তালিকাভুক্ত কোম্পানির আইন লঙ্ঘন করেছে।
তৃতীয়ত বলা হয়েছে সিভিল এভিয়েশন অথরিটি অফ বাংলাদেশের অনুমোদন না পাওয়ায় বনানী ডিএনসিসি ইউনিক কমপ্লেক্স বা শেরাটন হোটেলের ২১ থেকে ২৪ তম তলার কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। যা কোম্পানির আয়ের উপর একটি উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে জানানো হয়েছে। কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে এই ঘাটতি শেষ পর্যন্ত বিশেষ করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করতে পারে।
চতুর্থত বলা হয়েছে কোম্পানিটি কারওয়ান বাজারে অবস্থিত একটি ১৩ তলা বিশিষ্ট বোরাক জহির টাওয়ার নির্মাণের জন্য রাজউক থেকে অনুমোদন পেয়েছে। অথচ প্রতিবেদনে বিল্ডিংটিকে ২০ তলা হিসেবে দেখানো হয়েছে। যা অনুমোদন এখনও বাকি আছে। সেই সাথে ইস্যুকারীকে দু'টি হোটেল প্রকল্পের বিনিয়োগের সম্ভাব্য মূল্যায়ন প্রদান করতে হবে। এর মধ্যে ঢাকায় সাউথপার্ক ৭ স্টার হোটেল নির্মাণ, যার জন্য কোম্পানি ৪০০ কোটি টাকা থেকে ২০০ টাকা বরাদ্দ করতে চায়। এবং ইউনিক অ্যাক্রোপলিস নির্মাণে ১০০ কোটি টাকা ব্যয় করার কথা বলা হয়েছে। এর জন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মতো একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান দ্বারা ব্যাপক ব্যয়-সুবিধা বিশ্লেষণ পরিচালনা করার কথা বলা হয়েছে। যেখানে তহবিলের টাকা ব্যবহার করে এই ধরনের বিনিয়োগের সমালোচনা করা হয়েছে।
আর কোম্পানি হোটেল প্রকল্পগুলোর সম্ভাব্য মূল্যায়ন জমা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। যার ফলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আইপিওর বিষয়ে সাথে অসম্মতি জানিয়েছে।
এরপর জানানো হয়েছে কোম্পানি আইপিওর ১৫ শতাংশ শেয়ার কর্মচারীদের বরাদ্দ দেয়ার কথা জানালেও তাদের বিও নম্বারসহ প্রয়োজনীয় তথ্য জমা দেয়নি। যা আইনের অসঙ্গতি। সেই সাথে কোম্পানি গুলশানের প্রকল্প সাউথ পার্কের ৩৯.৪৫ ভূমি পুনঃমূল্যায়ন করে এর মূল্য ৬১.৩১ কোটি থাকে ২২৪.৭০ কোটি বাড়িয়ে ২৮৬.০১ কোটি টাকা দেখিয়েছে। যেখানে কোম্পানি এটাকে বিনিয়োগ সম্পত্তি হিসেবে দেখালেও ভবিষ্যতে অন্যপক্ষের কাছে এই জমি বিক্রি বা ভাড়া দেয়ার সুযোগ নেই। সুতরাং পুনঃমূল্যায়নের আয় বিবরণীতে দেখানো উচিত নয়। আর এর প্রভাব কাট অফ মূল্য নির্ধারণের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে জানানো হয়েছে।
অন্যদিকে বোরাক রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের সম্পত্তি, প্ল্যান্ট এবং সরঞ্জামগুলো বর্তমানে বিভিন্ন ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে বন্ধক রাখা হয়েছে। যার মাধ্যমে ব্যাংক এবং এনবিএফআইগুলোর কাছ থেকে ঋণ এবং ধার নেয়া হয়েছে৷ একইভাবে কোম্পানির বিনিয়োগ সম্পত্তিও একই উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বন্ধক রাখা হয়েছে। এদিকে ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টসের কাছে বোরাক রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের যে শেয়ারগুলো আছে তা ব্যাংক এবং এনবিএফআই থেকে ঋণ এবং ধার নেয়ার জন্য বিভিন্ন ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে জামানত হিসাবে বন্ধক রয়েছে। একইভাবে ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের শেয়ার প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড এবং ইউসিবি লিমিটেডের কাছে ঋণের জামানত হিসেবে বন্ধক রয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে কোম্পানির সম্পত্তি, শেয়ার এবং ইনভেন্টরি বন্ধক, বা জামানত রয়েছে, যা উল্লেখযোগ্যভাবে খেলাপির ঝুঁকি বাড়ায়। আর ঋণ খেলাপি হলে, ব্যাংক এবং নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) ঋণ পুনরুদ্ধারের জন্য এই সম্পদগুলো জব্দ করার অধিকার রাখে, যা কোম্পানির কার্যক্রমকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করতে পারে। ফলে কোম্পানির আর্থিক অবস্থার একটি বিভ্রান্তিকর চিত্র উপস্থাপন হতে পারে। বিনিয়োগকারীরা বিশ্বাস করে যে পুঁজিবাজার থেকে ৪০০ কোটি টাকা উত্তোলনের বিপরীতে কোম্পানিটির কাছে বেশি অর্থ ও সম্পদ রয়েছে। তাই আইপিও আবেদন মঞ্জুর করার আগে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগের বিষয়।
উপরের অসঙ্গতিগুলোর জন্য, কমিশন কোম্পানির ৪০০ কোটি টাকার আইপিও আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে বলে জানানো হয়েছে।