চুক্তি
অর্থনীতি
0

অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানির কাছে খনি ইজারা: মানতে হবে যে ২৮ শর্ত

হাজারও শ্রমজীবী মানুষের সহায়-সম্বল, সঞ্চয় সব ধুয়ে মুছে নিয়ে যুগ যুগ ধরে বেদনার উপাখ্যান রচনা করে চলেছে ব্রহ্মপুত্র নদ। সেই নদের গর্ভে ভারি খনিজ লুকিয়ে আছে কল্পনাও করেনি কেউ। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি বর্গকিলোমিটারে যেখানে আছে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি খনিজ। মহামূল্যবান সেসব খনিজ আহরণে এবার ৭৯৯ হেক্টর বালুচর ইজারা দিয়েছে সরকার।

উত্তরের এ জেলায় যমুনা-ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী চরাঞ্চলে প্রাপ্ত পাঁচ ধরনের খনিজ আহরণে ৭৯৯ হেক্টর জমির ইজারা পেয়েছে অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানি এভারলাস্ট মিনারেলস লিমিটেড।

গত বৃহস্পতিবার (২০ জুন) খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর (বিএমডি) মহাপরিচালক আব্দুল কাইয়ুম সরকার স্বাক্ষরিত পত্রে অস্ট্রেলিয়ান প্রতিষ্ঠান এভারলাস্ট মিনারেলস লিমিটেডকে ২৮টি শর্তে ইজারা মঞ্জুর করেন।

ইজারাপত্রে উল্লেখ করা হয়, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এভারলাস্ট মিনারেলস লিমিটেড’র অনুকূলে গাইবান্ধা সদর ও ফুলছড়ি উপজেলায় যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের চর এলাকায় বালাসী ব্লক-এ ৭৯৯ হেক্টর ভূমিতে ভারি খনিজ বালু আহরণের জন্য খনি ইজারা মঞ্জুরীর সম্মতি জ্ঞাপন করায় খনি ও খনিজ সম্পদ বিধিমালা, ২০১২ অনুযায়ী খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো (বিএমডি) ও এভারলাস্ট মিনারেলস লিমিটেডের মধ্যে খনি ইজারা চুক্তি সম্পাদিত হয়।

বিধি অনুযায়ী এ বছরের ২০ জুন থেকে ২০৩৪ সালের ২০ জুন পর্যন্ত আগামী ১০ বছর ইজারা গ্রহীতা প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট এলাকা থেকে জিরকন, রুটাইল, গারনেট, ম্যাগনেটাইট ও ইলমেনাইট এ পাঁচ ধরণের খনিজ বালু আহরণ করতে পারবে।

মূলত ফল-ফসল আবাদ-বসতি ভাসিয়ে বর্ষায় ফুঁসে ওঠা যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের ঘূর্ণিপাকে এ অঞ্চলের মানুষের হাবুডুবু করার গল্পটা বহু বছরের পুরনো। প্রবল স্রোত আর ঢেউ যাদের ফসলের ক্ষেত বা বসতভিটা কেড়ে নেয় তাদের কাছে রাক্ষস বলেই পরিচিত ব্রহ্মপুত্র। বন্যা-খড়া আর ভাঙ্গনের মতো দুর্যোগ-দুর্বিপাকে কপালে আটা মঙ্গার তিলক যখন ঘুচতেই চায় না গাইবান্ধার খেটে খাওয়া মানুষের কপাল থেকে। তখন অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকা চরের বালিতে লুকিয়ে থাকা মূ্ল্যবান ও ভারি এসব খনিজ প্রাপ্তি ও আহরণ প্রক্রিয়ার খবর ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন গাইবান্ধার সচেতন নাগরিকরা।

মুল্যবান এসব খনিজ আহরণের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে গণ উন্নয়ণ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক এম আব্দুস সালাম ও গাইবান্ধা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব ফরহাদ আব্দুল্যাহ হারুন বাবলু বলেন, এখান থেকে প্রাপ্ত খনিজের রাজস্ব থেকে যদি গাইবান্ধায় কল কারখানা স্থাপনে সরকার নজর দেয়, তবে পিছিয়ে পড়া এ অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

সরকারি প্রতিষ্ঠান খনিজ গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক ড. নাজিম জামানের তথ্যমতে ১০ মিটার গভীরতায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে থাকা খনিজের বাজারমূল্য সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি।

এখানে প্রাপ্ত পাঁচ খনিজের ব্যবহার:

জিরকন: সিরামিক, টাইলস, রিফ্যাক্টরিজ ও মোল্ডিং সেন্ডসে (ছাঁচ নির্মাণে ব্যবহৃত বালু) ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে সারা বিশ্বে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, চীন, ব্রাজিল, সিয়েরা লিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র এ খনিজ উপাদানটি রপ্তানি করে থাকে।

রুটাইল: রং, প্লাস্টিক, ওয়েলডিং রড, কালি, খাবার, কসমেটিকস, ওষুধ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় রুটাইল। অস্ট্রেলিয়া, ভারত, ইতালি, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, সিয়েরা লিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র মূল্যবান এই খনিজটি সারা বিশ্বে রপ্তানি করে।

গারনেট: সিরিশ কাগজ উৎপাদন, লোহাজাতীয় পাইপ পরিষ্কার ও বালুতে বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য ব্যবহার হয়। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া ও ভারত সারা বিশ্বে খনিজটি রপ্তানি করে থাকে।

ম্যাগনেটাইট: চুম্বক উৎপাদন, ইস্পাত উৎপাদন, খনি থেকে উত্তোলিত কয়লা পরিষ্কার করা ও তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে গভীর কূপ খননে ব্যবহার হয়ে থাকে। বিশ্বের মাত্র দুটি দেশ অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা মূল্যবান এ খনিজটি সারা বিশ্বে রপ্তানি করে থাকে।

ইলমেনাইট: টিটেনিয়াম মেটাল তৈরি, ওয়েল্ডিং রড তৈরি ও রং উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়। অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফিকা, মাদাগাস্কার, মোজাম্বিক, ইন্দোনেশিয়া ও ভারত মূল্যবান এ খনিজটি সারা বিশ্বে রপ্তানি করে।

যেসব শর্তে চরাঞ্চল ইজারা দেয়া হয়েছে:

১. সকল ক্ষেত্রে খনি ও খনিজ সম্পদ বিধিমালা ২০১২ এর বিধি ও সম্পাদিত খনি উজারা চুক্তির শর্তসমূহ অনুসরণ করতে হবে।

২. বিএমডি, বাংলাদেশ ভূতাত্বিক জরিপ অধিদপ্তর (জিএসবি) ও স্থানীয় প্রশাসন খনি কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করবে।

৩. খনি কার্যক্রমের সব ক্ষেত্রে স্থানীয় জনগণের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে কারিগরি দক্ষতা অর্জনে বাংলাদেশের নাগরিকদের দেশে বা বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

৪. উৎপাদিত ভারি খনিজ দ্রব্য স্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

৫. মঞ্জুরীকৃত এলাকার বাইরে খনি কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না।

৬. খনি কার্যক্রমের কোনো পর্যায়ে কৃষি জমি নষ্ট বা জনবসতি উচ্ছেদ করা যাবে না।

৭. পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা যাবে না।

৮. প্রকল্প এলাকায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

৯. প্রচলিত বিধি-বিধান অনুসরণ করে খনি কার্যক্রমে নিয়োজিত শ্রমিকদের বীমা সুবিধা, শ্রমঘণ্টাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।

১০. খনি কার্যক্রমে শ্রমিক দূর্ঘটনায় পতিত হলে বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

১১. কার্যক্রম শুরু করার আগে নিয়ম-কানুন ও বিধির আওতায় প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সকল সংস্থার কাছ থেকে অনুমতি/ছাড়পত্র নিতে হবে।

১২. খনি এলাকায় উত্তোলিত, স্থানান্তরকৃত, রপ্তানি ও অপসারণকৃত খনিজের সঠিক হিসাব সংরক্ষণ করতে হবে এবং প্রতি মাসের সাত তারিখের মধ্যে এসব তথ্য বিএমডিতে দাখিল করতে হবে। যা ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর যাচাই করবে। কার্যক্রম শুরুর তিন মাসের মধ্যে ইজারা গ্রহীতা অনলাইন সফটওয়্যার ডেভেলপ করবেন। যাতে তথ্যসমূহ খনিজ সম্পদ বিভাগ ও বিএমডির কাছে সহজে প্রদর্শিত হয়।

১৩. খনিজ পদার্থ বিক্রয়ের ক্ষেত্রে দেশিয় শিল্প ও স্থানীয় বাজার সৃষ্টিতে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের পর উৎপাদিত অতিরিক্ত খনিজ পদার্থ বিধি মেনে বিদেশে রপ্তানির ব্যবস্থা করতে হবে।

১৪. খনিজ সম্পদ বিধিমালা অনুযায়ী প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে বিএমডির মহাপরিচালকের কাছে রয়্যালিটি জমা করতে হবে।

১৫. আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় বাজারমূল্যের উপর ভিত্তি করে গাইবান্ধা জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি, বিএমডি, জিএসবি এবং ইজারা গ্রহীতার সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি উত্তোলিত খনিজের খনিমুখের মূল্য নির্ধারণ করবেন।

১৬. বিএমডি, জিএসবি, পরমাণু শক্তি কমিশন এবং জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত একটি পৃথক কমিটি খনিজ পৃথকীকরণের পর অব্যবহৃত বালুর ব্যবহার ও বিক্রির ব্যবস্থা করবে।

১৭. ইজারা গ্রহীতা পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ করতে পারবেন না।

১৮. পরিবেশ অধিদপ্তর তার প্রদত্ত ছাড়পত্রের আওতায় খনি খনন কার্যক্রমের ফলে পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ করবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

১৯. কোনো তেজস্ক্রিয় পদার্থ পাওয়া গেলে খনিজ সম্পদ বিধিমালা ২০১২ এর বিধি ৫ (৯) অনুযায়ী ব্যবস্থা করা হবে।

২০. খনি কার্যক্রমের কোনো পর্যায়েই স্থানীয় বসতি উচ্ছেদ করা যাবে না।

২১. উত্তোলিত বালু স্থানীয় জনগণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও খেলার মাঠ উন্নয়ন/ভরাটকরণে ব্যবহার করা যাবে।

২২. নদীর গতিপথ পরিবর্তন রোধে প্রতিটি ব্লকের সাব-ব্লক খননের গর্তসমূহ বন্যার পূর্বে বালু/মাটি দ্বারা ভরাট করতে হবে।

২৩. নদীর তলদেশ হতে খনিজ উত্তোলনের ক্ষেত্রে যথাযথ ঢাল সংরক্ষণপূর্বক সুইং করে নদীর তলদেশ সুষম স্তরে খনন করতে হবে।

২৪. পরিবশে , বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, স্থানীয় প্রশাসন, বিএমডি ও জিএসবির প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত কমিটি খনিজ আহরণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ঝুঁকি চিহ্নিতকরণ এবং ঝুঁকি নিরসনে ব্যবস্থা গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন কার্যক্রম তদারকি করবে।

২৫. ইজারা গ্রহীতা তার দাখিলকৃত খনি খনন পরিকল্পনা অনুযায়ী বালাসী ব্লক-এ এলাকার জন্য ৭৩৮ জন লোককে ইজারা মেয়াদে নিয়োগ দিতে পারবে।

২৬. ইজারা গ্রহীতা খনি খনন এলাকার পাশ্ববর্তী খনি কার্যক্রমের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত স্কুল, কলেজ, ক্লিনিক, হাসপাতালসহ বিভিন্ন ধরনের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে জেলা প্রশাসক ও বিএমডির চাহিদামতো সহযোগিতা করবে।

২৭. সরকার ও ইজারা প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক জারিকৃত নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে।

২৮. বিএমডি বিধি অনুযায়ী ইজারা গ্রহীতার সকল কার্যক্রম মনিটরিং করবে এবং ইজারা গ্রহীতা তা যথাযথভাবে প্রতিপালন করবে। এক্ষেত্রে বিদ্যমান বিধিমালার কোনো শর্ত ভঙ্গ করলে বিধি ৮৪ মোতাবেক বিএমডি ইজারা গ্রহীতার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

সরকারি প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব মাইনিং, মিনারোলজি অ্যান্ড মেটালার্জি ব্রহ্মপুত্র নদে জরিপ চালিয়ে প্রাথমিকভাবে বালিতে খনিজের উপস্থিতি পায়। এরপর ২০২০ সালে জয়পুরহাটে অবস্থিত খনিজ প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় পাঁচ খনিজের উপস্থিতি চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত করেন গবেষকরা। বেশ ক’বছর ধরে গাইবান্ধায় ৪ হাজার হেক্টর বালুচরে খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান শেষে বালাসীঘাটে একটি প্লান্ট স্থাপন করে অস্ট্রেলিয়ান প্রতিষ্ঠানটি।

গাইবান্ধার প্রায় চার হাজার হেক্টর বালুচরজুড়ে দীর্ঘ গবেষণার পর ২ হাজার ৩৯৫ হেক্টর এলাকা ইজারা চেয়ে আবেদন করলে গত ২০ জুন গাইবান্ধা সদর ও ফুলছড়ি উপজেলায় ৭৯৯ হেক্টর চরাঞ্চল ভারি খনিজ খনি হিসেবে ১০ বছরের জন্য অস্ট্রেলিয়ান প্রতিষ্ঠান এভারলাস্ট মিনারেলস লিমিটেডকে ইজারা মঞ্জুরী দেয় খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো-বিএমডি।

আহরণের পর খনিজের ৪৩ ভাগ সরকার আর বাকিটা পাবে এভারলাস্ট মিনারেলস লিমিটেড। খনিজ সমৃদ্ধ ২ হাজার ৩৯৫ হেক্টর বালুচরকে তিনভাগে বিভক্ত করার পর ব্লক এ ইজারা দেয়া হয়েছে। বাকি ব্লক দুটির ইজারা এখনো প্রক্রিয়াধীন। গবেষকরা বলছেন, প্রতিবছর বন্যায় উজান থেকে নেমে আসা ঢলের সাথে এই অঞ্চলে এসে জমা হবে এসব খনিজ সম্পদ। তাই কখনোই এই খনিজ এখান থেকে ফুরিয়ে যাবে না বলে ধারণা করছেন তারা।

এভিএস

এই সম্পর্কিত অন্যান্য খবর