এ যেন স্বপ্নের বুনন। সেলাই মেশিনের গতিময় ছন্দে সমৃদ্ধির গল্পগাঁথা। উদয়-অস্ত সেলাই দিদিমনিদের শ্রম-ঘামের বিনিময়ে রঙিন হচ্ছে পোশাক শিল্প।
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি পোশাক খাত। দ্রুত বর্ধনশীল এই খাতের সাথে জড়িত দেশের প্রায় ৫০ লাখেরও বেশি মানুষ। তবে বেশিরভাগ শ্রমিক আছেন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। নিরাপদ কর্মপরিবেশ, মজুরি বৈষম্য আর শ্রম অধিকার থেকে অনেকটাই বঞ্চিত এই খাতের কর্মীরা।
বর্ধনশীল এই খাতের বিকাশ ঘটছে জীবাশ্ম জ্বালানিকে কেন্দ্র করে। যা শ্রমঘন শিল্প, কাজের পরিবেশ, শ্রমিকের স্বাস্থ্যমানে ফেলছে নেতিবাচক প্রভাব। তবে জ্বালানি সাশ্রয়, কার্বন নিঃসরণ কমানো ও বিদেশি ক্রেতাদের চাপে রপ্তানিমুখী এই শিল্পে বাড়ছে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার। যার ফলশ্রুতিতে গ্রিন সনদপ্রাপ্ত কারখানার সংখ্যা ছাড়িয়েছে দুই শতাধিক।
কারখানা সবুজ হলেও শ্রমিকের ধূসর জীবন কি সবুজ হচ্ছে? স্বাস্থ্য সুরক্ষার অভাব, উচ্চ তাপমাত্রা, নিরাপত্তার অভাব অসহনীয় করে তুলছে শ্রমিকের জীবন। নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে লড়ে যেতে হয় তাদের।
পোশাক শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবি, জ্বালানি সুরক্ষার অগ্রগতির সাথে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত ও ঝুঁকি মোকাবিলায় বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ রাখতে হবে।
সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, ‘গ্রিন ফ্যাক্টরিগুলোতে কি শ্রমিকরা ইউনিয়ন করতে পারতেছে? ন্যায্য বা বাঁচার মতো মজুরি পাচ্ছে? তারা কি হয়রানি থেকে মুক্ত আছে? অবশ্যই না।’
সময়ের সাথে পোশাক কারখানার চিত্র বদলালেও বদলায় না শ্রমিকের ভাগ্য। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ বলছে, নবায়নযোগ্য জ্বালানির যে রূপান্তর প্রক্রিয়া সেখানে বৈষম্য রয়ে গেছে। সংস্থাটির আশঙ্কা, পেশাগত স্বাস্থ্যমান, মজুরিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা না গেলে ২০৫০ সাল নাগাদ এই খাতের প্রায় ৬০ শতাংশ শ্রমিক কর্মহীন হতে পারে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের মহাসচিব নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘তাদের কর্মপরিবেশ অতটা সবুজ না। তাদের মজুরি, সুযোগ-সুবিধা, অধিকার গ্রিন না। আর তাদের জীবন ও জীবিকা ধূসর হয়ে যাচ্ছে। তার জন্য সামাজিক সুরক্ষার কি ব্যবস্থা আছে? বাংলাদেশে প্রচলিত আইনে কোনো সুরক্ষার ব্যবস্থা নাই।’
জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ২০৩০ সাল নাগাদ কার্বন নির্গমন ৩০ শতাংশ কমানোর প্রতিশ্রুতি শিল্প মালিকদের। তবে পরিবেশবান্ধব সরঞ্জাম স্থাপনের ব্যয় অন্যতম বাধা। তাই শুল্কমুক্ত সহায়তা পেলে শ্রমিকদের মজুরির সুবিধা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি।
ফতুল্লা অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘সরকারের কোনো বিনিয়োগ নাই, ভর্তুকি নাই, চুরিরও কোনো সম্ভাবনা নাই। কিন্তু বিভিন্নভাবে তারা এখানে প্রায় ৩০ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে রেখেছে। কিছু জায়গায় ৫২ শতাংশ। ভর্তুকি তো দিচ্ছেই না, বরং পরিবেশবান্ধব জিনিসের ওপর উচ্চহারে কর আরোপ করে রেখেছে। স্বাভাবিকভাবে কারখানার সক্ষমতা বাড়লে শ্রমিকদের বেতন বাড়াতে পারবে।’
পরিবেশ সুরক্ষায় বৈশ্বিক মানদণ্ড নিশ্চিত, টেকসই জ্বালানি ব্যবস্থা ও শ্রমিকের ন্যায্যতা নিশ্চিতের বিকল্প নেই। পোশাক খাতে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার, শ্রমিকের নিরাপত্তা ও কল্যাণে কাজ করছে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা। উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিচ্ছন্ন জ্বালানি শক্তির ব্যবহার ও শ্রমিকের মতামতকে গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ তাদের।
কার্বন নিঃসরণ, নদীদূষণ ও পরিবেশগত ক্ষতির কারণ হিসেবে চিহ্নিত সিংহভাগ পোশাক কারখানা। জৈব জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে টেকসই নবায়নযোগ্য জ্বালানির নীতি বাস্তবায়নের পরামর্শ জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের। জ্বালানি রূপান্তর প্রক্রিয়ার উৎপাদন খরচ কমিয়ে তার লভ্যাংশ শ্রমিকের কল্যাণে বণ্টন জরুরি।
সামাজিক ও পরিবেশগত কারণে বিদেশি ক্রেতাদের আগ্রহ সবুজ কারখানায়। তবে বাস্তবিক অর্থে এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে দক্ষতার অভাব রয়েছে শ্রমিকদের। পোশাক মালিক সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, কার্বন নিঃসরণ কমানোর কৌশল প্রণয়নে শ্রমিকের অংশীদারিত্ব বাড়ানোর পাশাপাশি অর্থায়নের পরিকল্পনাও হাতে নেয়া হয়েছে।
এদিকে, পোশাক খাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে নবায়নযোগ্য জ্বালানি, মন্তব্য বন-পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক উপদেষ্টার। তবে এই প্রক্রিয়ায় শ্রমিকের ন্যায্যতা নিশ্চিত করা সময়সাপেক্ষ হলেও তা বাস্তবায়নের আশ্বাস।
জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণ কারখানাগুলোর উত্তরণের পথ। তাই বিনিয়োগের পাশাপাশি কর্মীদের মানবাধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। তবেই বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকবে দেশের পোশাক শিল্প ও শিল্পী।