আমদানি-রপ্তানি
অর্থনীতি
0

ইউরোপে জনপ্রিয় হচ্ছে 'মেড ইন বাংলাদেশ' বাইসাইকেল

চট্টগ্রাম

যান্ত্রিক যানবাহন আর গতির এ যুগে অনেকের কাছে এখনও প্রিয় অযান্ত্রিক বাহন বাইসাইকেল। কারও কাছে রুটি-রুজি, কারও কাছে শখের এ বাহন এখনও দাপিয়ে বেড়ায় নগরীর সড়ক। গবেষণা বলছে, দেশে সাইকেলের বাজার প্রায় ৮০০ কোটি টাকার, যা ২০২৯ সালে পৌঁছাবে এক হাজার কোটিতে। পাশাপাশি ইউরোপের নানা দেশের সড়কেও আধিপত্য আছে মেড ইন বাংলাদেশের সাইকেলের।

সূর্য উঠার আগেই লক্ষণ চন্দ্রের প্রতিটি দিন শুরু হয় সাইকেলের সাথে। গেলো ৩০ বছর ধরে এ বাহনে করেই আয় উপার্জন আর সংসারের খরচ জুগিয়েছেন তিনি। ঝড় ঝঞ্ঝা, তীব্র রোদ মাথায় নিয়ে পত্রিকা নিয়ে ছুটে চলেন নগরের অলি গলিতে।

শুধু লক্ষণই নয়, তার মতো আরও শত শত হকার প্রতিদিন ভোরে নগরীর চেরাগী থেকে পত্রিকা সংগ্রহ করেন। ছুটেন বাই সাইকেলে। অনলাইন সাইটের ভোক্তাদের অর্ডার দেয়া পণ্য পৌঁছে দেয়া, কর্মব্যস্ত মানুষের অফিসে যাতায়াত, কিংবা তরুণদের শখের বসে প্যাডেলে চাপ দেয়ার দৃশ্য চোখে পড়ে হরহামেশাই। এসব মানুষের কাছে যান্ত্রিক বাহনের যুগে এখনও যেনো সমান আবেদনময়ী অযান্ত্রিক এ বাহন।

হকার লক্ষণ সাইকেলে পত্রিকা বিক্রি করে সংসার চালান। ছবি: এখন টিভি

লক্ষণ চন্দ্র বলেন, 'কোনো জ্যাম বাজলে সুবিধা হয়, কেরিয়ার থাকার জন্য সুবিধা হয়। আর অন্য গাড়িতে করে দিতে হলে খরচ বেশি হবে আমাদের । সাইকেলে করে দেয়ার জন্য আমাদের খরচ অনেক কম হয়।'

দুই চাকার বাহন সাইকেল যে জনপ্রিয় হচ্ছে তা অলিগলিতে নজর দিলেই বোঝা যায়। নগরীর নিউ মার্কেট মোড়ের দক্ষিণ পাশের স্থানটিতে বছর ত্রিশ আগে ৫ থেকে ১০ টি দোকান থাকলেও এখন সে সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৩০টি। আবার একসময়ের আমদানীকৃত সাইকেল দিয়েই চাহিদা মিটলেও এখন বাজারে আধিপত্য করছে দেশিয় ব্র্যান্ডগুলো। তবে দেশি সাইকেলের দাম বেশি হওয়ায় অনেকেই ঝুঁকছেন সস্তা বিদেশি বাই সাইকেলের দিকে।

বৈশ্বিক ওয়েবসাইট স্ট্যাটিস্টার তথ্য মতে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশে বাইসাইকেলের বাজার প্রায় ৮০০ কোটি টাকার। এ বাজার ২০২৯ সালে বাংলাদেশে বাই দাঁড়াবে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকায়। বিক্রেতারা জানান, মূলত করোনার সময় থেকে দেশে সাইকেলের কদর বাড়ে থাকে। এরপর জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে সাইকেলে বাজারে।

দেশে সাইকেলের বাজার এক দশক আগেও ছিল আমদানি নির্ভর। চীন ভারত থেকে আমদানি করে দেশে সাইকেলে চাহিদা মেটানো হতো। তবে ২০১১ সাল থেকে দেশিয় তিনটি প্রতিষ্ঠানের সাইকেল বাজারে আসে। এখন বাজারের একটি বড় অংশ দেশিয় প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে আছে।

এতো গেলো দেশের বাজারের কথা। ইউরোপসহ বিশ্বের নানা দেশের সড়কে এখন মেইড ইন বাংলাদেশ বাইসাইকেল জায়গা করে নিয়েছে।

পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে বিশ্বব্যাপী বাড়ছে বাইসাইকেলে ব্যবহার। পরিবেশবান্ধব এই বাহনটির বিশ্বব্যাপী ৬৩ বিলিয়ন ডলারের বাজার রয়েছে। ২০২৯ সালে যা ৭০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। জানলে অবাক হবেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সড়কে যেসব সাইকেল চলে তার অনেকটাই তৈরি হয় বাংলাদেশে। বর্তমানে বিশ্ববাজারে বাইসাইকেল রপ্তানিতে বাংলাদেশের হিস্যা কম হলেও ধীরে ধীরে বাড়ছে বাংলাদেশে উৎপাদিত সাইকেলের বাজার।

চট্টগ্রাম ইপিজেড এর একটি কারখানা আলিটা বিডি ১৯৯৫ সাল থেকে কার্যক্রম শুরু করে। কারখানার একটি অংশে সাইকেলের ফ্রেমগুলোকে ক্যামিকেল মিশ্রণের মাধ্যমে শুরু হয় মূলত সাইকেল তৈরির কর্মযজ্ঞ। এরপর তা শুকিয়ে নেয়া হয় যন্ত্রের মাধ্যমে। পরে সেগুলো চলে যায় পেইন্টিং সেকশনে।

এখানে অটোমেটিক মেশিনে রং করা হয় সাইকেলে ফ্রেমে। ক্রেতার পছন্দ ও চাহিদা অনুযায়ী নানান বর্ণের ফ্রেম করা হয়। এরপর সেগুলো চলে যায় স্টিকার সেকশনে। এখানে মূলত নানান রকমের স্টিকার সাইকেলের ফ্রেমে সেঁটে দেয়া হয়। যা সাইকলেকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। এরপর সেগুলোতে পর্যায়ক্রমে চেইন, হ্যান্ডেল এবং চাকা সংযোজন করা হয়।

বিশ্বে নানান ধরনের বাইসাইকেল রয়েছে। এর মধ্যে মাউন্টেন বাইক, রেসিং ও ভিএমএক্স অন্যতম। ইপিজেড এর এ কারখানায় সব ধরনের সাইকেলই তৈরি হয়।

আলিটা বিডির প্রোডাকশন ম্যানেজার স্বপন দাশ বলেন, 'যুক্তরাজ্য, জার্মান, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র থেকে অর্ডার পেয়ে আমরা কাজ করে থাকি। আর আমাদের ক্যাপাসিটি অনুযায়ী প্রতিমাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার সাইকেল তৈরি করি।'

মূলত আলিটা বিডির হাত ধরেই বিশ্ববাজারে মেড ইন বাংলাদেশ বাইসাইকেল যাত্রা শুরু করে। বাংলাদেশে এখন ৫ থেকে ৭টি প্রতিষ্ঠান বাই সাইকেল রপ্তানি করছে। মূলত ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোই বাংলাদেশের সাইকেলে প্রধান ক্রেতা। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি সাইকেলে কেনে জার্মানি, এরপর যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রিয়া অন্যতম। ইউরোপীয় ইউনিয়নে যেসব দেশ সাইকেল রপ্তানি করে তার মধ্যে চতুর্থ অবস্থানে আছে বাংলাদেশ।

আলিটা বিডির মহাব্যবস্থাপক এ এইচ এম ফেরদৌস বলেন, 'ইউরোপীয় ইউনিয়ন সবসময় চায় চায়নার বলয় থেকে সাইকেল ইন্ডাস্ট্রিটা বের করে আনার জন্য। ফলে তারা আমাদের একটা আলাদা সুবিধা দেয়। এজন্য আমাদের পণ্য ওই দেশে খুব এট্রাক্টিভ হয়। এটা আমাদের জন্য একটা অ্যাডভান্টেজ।'

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ১৬৭.৯৫ মিলিয়ন ডলারের সাইকেল রপ্তানি করে।২০২২-২৩ অর্থ বছরে রপ্তানি হয় ১৪২.২৪ মিলিয়ন ডলারের। আর সবশেষ অর্থবছরের ১০ মাসে সাইকেল রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৭২.৬৫ মিলিয়ন ডলারের। রপ্তানি কমার পেছনে করোনা ও ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধকে দায়ী করছেন রপ্তানিকারকরা।

এ এইচ এম ফেরদৌস বলেন, 'আমাদের এশিয়ান দেশগুলোর মধ্যে চায়না আর তাইওয়ান ছাড়া আমাদের বিট করার মতো সক্ষমতা কারও নেই। তাদের থেকে ডিউটি বেনিফিট পাওয়ার পর আমাদের পণ্যের যে কোয়ালিটি, তা বিট করা ভারতের পক্ষে কয়েক দশকে সম্ভব না। এছাড়া আর কারও সক্ষমতা একেবারেই নেই।'

সাইকেলের বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের আধিপত্য বাড়াতে জিএসপি সুবিধা অর্জন ও নতুন বাজার খোঁজার পরামর্শ কারখানা মালিকদের ।

এমএসআরএস

এই সম্পর্কিত অন্যান্য খবর